পায়েল কাপাডিয়ার All We Imagine as Light: নিঃসঙ্গতার মাঝে প্রতিবাদের শক্তিশালী গল্প - রিটন খান
All We Imagine as Light কেবল তিনটি নারীর জীবনের গল্প নয়; এটি আমাদের শেখায় কিভাবে দেখা ও না-দেখার, পাশে থাকা ও পৃথক থাকার মাঝের সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজে পেতে হয়।
"আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে প্রেম করতে হয় লুকিয়ে, অথচ দিনের আলোয় সহিংসতা চলে প্রকাশ্যে।" — জন লেনন
পায়েল কাপাডিয়ার All We Imagine as Light আধুনিক মুম্বাইয়ের এক অসাধারণ আবেগময় পর্যালোচনা, যেখানে গল্পটি প্রভা, অনু, এবং পার্বতীর জীবনকে কেন্দ্র করে। তাঁর কানে-জয়ী প্রথম চলচ্চিত্রটি এক নীরব, অথচ গভীর শক্তিশালী ন্যারেটিভ তুলে ধরে, যা কেবল জীবনযাপন নয়; বরং চরিত্রগুলির মধ্যে গড়ে ওঠা সেই সূক্ষ্ম সম্পর্কের মায়াজাল, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এবং আত্ম-সচেতনতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যা তাদের শুধু একে অপরের সঙ্গে নয়, সেই ব্যস্ত শহরের সঙ্গেও মেলবন্ধন ঘটায়।
৬০তম শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে All We Imagine as Light দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, এবং কাপাডিয়ার স্ক্রিনপ্লে ও গল্প বলার কৌশল আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে। তাঁর ন্যারেটিভে এমন এক নীরবতার অনুভূতি আছে যা মেলোড্রামা ছাড়াই প্রবল আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রতিটি ফ্রেম যেন এক একটি চিত্রকবিতা, যেখানে মুম্বাইয়ের উচ্ছল রাস্তাগুলি এই নারীদের অন্তর্গত অনুভূতির বিপরীতে অবস্থান করছে। কাপাডিয়ার সিনেমাটোগ্রাফি বিশেষভাবে অনন্য—একদিকে ঠান্ডা নীলাভ রঙের প্রাধান্য, অন্যদিকে সোনালী উষ্ণতার ক্ষীণ উপস্থিতি যেন চরিত্রগুলির অভ্যন্তরীণ আবেগকে প্রতিফলিত করে। শহরের কঠোর বাস্তবতার থেকে শান্ত উপকূলীয় গ্রামের দিকে যাত্রা কেবল ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়; এটি এক আবেগের রূপান্তর, যা বিচ্ছিন্নতা থেকে পুনঃসংযোগের প্রতীক হিসেবে দাঁড়ায়।
প্রভা চরিত্রে কানি কুসরুতির অভিনয় এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর অভিনয় সরল হলেও গভীরভাবে আবেগপূর্ণ, বিশেষ করে যখন তিনি তাঁর ব্যর্থ বিবাহের স্মৃতির মুখোমুখি হন। একটি রাইস কুকার—সম্ভবত তাঁর প্রবাসী স্বামীর পাঠানো উপহার—প্রভা’র কাছে এক প্রতীকী মুহূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি রাইস কুকারটিকে নিঃশব্দ ঘরের কোণে আলিঙ্গন করেন, যেন এটি সেই অন্তরঙ্গতার প্রতীক যা তাঁর জীবনে বহুদিন অনুপস্থিত ছিল। এই দৃশ্যটি গভীরভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে। কাপাডিয়া যেন এভাবেই আমাদের বুঝিয়ে দেন: এই নারীরা শুধু বাহ্যিক জগতের জটিলতা নয়, নিজেদের ভেতরকার অস্থিরতার সঙ্গেও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন।
প্রেম এবং আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণে কাপাডিয়া তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে অনেক পরিচালক প্রেমকে বিশাল ও নাটকীয় আকারে উপস্থাপন করতে চান, সেখানে কাপাডিয়া প্রেমকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। অনু এবং শিয়াজের সম্পর্ক, যা গোপনীয়তার আবরণে ঢাকা, অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সূক্ষ্ম উত্তেজনার রঙে রাঙানো। কাপাডিয়া এই প্রেমের মুহূর্তগুলোকে পর্দায় তুলে ধরেছেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে, যাতে আমরা সমাজের চাপ এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের গভীরতা অনুভব করতে পারি।
চলচ্চিত্রের মাঝপথে যখন আমরা মুম্বাইয়ের কোলাহল ছেড়ে পার্বতীর উপকূলীয় গ্রামের শান্ত পরিবেশে পা রাখি, তখন গল্পটি যেন এক নতুন মুক্তির পথে প্রবেশ করে। শেকসপিয়ারের টেম্পেস্ট-এর মতোই এখানে স্বপ্নময় মুহূর্তের উদ্ভাস ঘটে। প্রভা’র এই ভ্রমণ, যা শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে ঘটে, এক অলৌকিক রূপ ধারণ করে। গ্রামে এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমন, এবং গ্রামের লোকেদের তাকে প্রভা’র স্বামী বলে ভুল করা, গল্পের বাঁকটিকে হয়তো সামান্য নাটকীয় করে তোলে। তবে কাপাডিয়া এই মুহূর্তটিকে প্রভা’র বিচ্ছেদ এবং আকাঙ্ক্ষার গভীরে যাওয়ার পথ হিসেবে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন, যা তার আত্ম-অন্বেষণকে আরও অর্থবহ করে তোলে।
আমার কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছে যেভাবে কাপাডিয়া নারীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিবাদের ভাষায় রূপ দিয়েছেন। এমন একটি সমাজে, যেখানে নারীর চাওয়া-পাওয়ার সীমা সামাজিক কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত, সেখানে প্রভা, অনু, এবং পার্বতীর গল্প নীরব কিন্তু দৃঢ়ভাবে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। এরা শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইয়ে ব্যস্ত নন; বরং সেই সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও লড়ছেন, যা তাদের স্ত্রী, কন্যা, কিংবা সহকর্মীর পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে, All We Imagine as Light শুধুমাত্র সংযোগের গল্প নয়, বরং প্রতিবাদেরও একটি সিনেমা।
অনেকেই বলেছেন কাপাডিয়ার এই চলচ্চিত্রটি তাদের সত্যজিৎ রায়ের মহানগর সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমিও মনে করি দুটো সিনেমাই শহুরে জীবনে নারীর আকাঙ্ক্ষার জটিলতাকে দারুণভাবে তুলে ধরেছে, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটি যেখানে আশাবাদী সুরে সমাপ্ত হয়, সেখানে কাপাডিয়া আমাদের একটি অনির্দিষ্ট এলাকায় ফেলে রেখে যান। এখানে কোনো সোজাসাপ্টা সমাধান নেই, কোনো সুসংগঠিত সমাপ্তিও নেই। বরং আমরা অনুভব করি যে এই নারীদের যাত্রা এখনও অসমাপ্ত, এবং তাদের গল্প—শহরটির মতোই—চমকপ্রদ ও অনিবার্যভাবে আরও গভীর এবং জটিল রূপে উন্মোচিত হতে থাকবে।
All We Imagine as Light কেবল তিনটি নারীর জীবনের গল্প নয়; এটি আমাদের শেখায় কিভাবে দেখা ও না-দেখার, পাশে থাকা ও পৃথক থাকার মাঝের সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজে পেতে হয়। এই সিনেমাটি আমাদের চিন্তায় প্ররোচনা দেয়—যদি আমরা আমাদের চারপাশের মানুষ এবং পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখার সুযোগ দিই, তাহলে সম্ভাবনার কেমন নতুন দুয়ার আমাদের সামনে খুলে যেতে পারে। আমার জন্য, এটাই কাপাডিয়ার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলা, দৈনন্দিনকে অলৌকিকের রূপ দেওয়া। শিকাগো ফেস্টিভ্যালে এই সিনেমাটি দেখে স্ক্রিনপ্লে নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস আরও বেড়ে গেছে, এবং আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি এটি বিশ্বব্যাপী দর্শকদের মধ্যে কেমনভাবে সাড়া জাগায় তা দেখার জন্য।
অস্কার প্রসঙ্গ
All We Imagine as Light আন্তর্জাতিক মহলে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে, বিশেষত কানে গ্র্যান্ড প্রাইজ জেতার পর। তবে এটি অস্কারের জন্য ভারত থেকে মনোনীত না হওয়াটা এক বড় মিস। এই চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক মানে তৈরি, যেখানে ভারতীয় সমাজ, বিশেষত নারীদের সামাজিক অবস্থান ও আধুনিক শহুরে জীবনের জটিলতা নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। এটি নিছক একটি গল্প নয়; বরং নারীর আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের নিঃশব্দ কিন্তু গভীর প্রতিরোধের প্রতীক। এমন গল্প পশ্চিমা দর্শকদের যেমন আকর্ষণ করে, তেমনি ভারতীয় বাস্তবতার প্রতিফলনও তুলে ধরে। এ সিনেমাটি কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারীর জীবন ও সম্পর্কের জটিলতাকেও ব্যাখ্যা করে।
ভারতীয় সিনেমা বোর্ডের বাছাইয়ে সাধারণত একটি প্রাচীন মানসিকতা কাজ করে, যেখানে তাঁরা গ্লিটজ ও গ্ল্যামারের দিকে বেশি ঝোঁকেন। এ বছরও তাঁরা Laapataa Ladies বেছে নিয়েছেন—একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সিনেমা, যা হয়তো বিনোদনমূলক এবং জনপ্রিয় হতে পারে, তবে অস্কারের আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেভাবে প্রভাব রাখতে পারে না। ভারতের অস্কার বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে, কারণ প্রক্রিয়াটি অনেক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে দেশের শক্তিশালী উপস্থাপনা থেকে বঞ্চিত হয়।
All We Imagine as Light যখন শিকাগো চলচ্চিত্র উৎসবে দেখলাম, তখন মনে হয়েছিল, এমন গল্প সহজেই বিশ্বব্যাপী দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে পারে। কিন্তু অস্কার মনোনয়ন নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত আবারও হতাশ করল।