শেকড়ের লড়াই: আসামে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
সুকুমার বিশ্বাসের বই নিয়ে এক পর্যালোচনা। শুধু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নয়, এটি এক লড়াইয়ের দলিল। যারা ভাষা, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য।
আসামে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা প্রসঙ্গ
সুকুমার বিশ্বাস
সুকুমার বিশ্বাসের আসামে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা প্রসঙ্গ বইটি পড়তে গিয়ে বারবার ভাবতে হয়েছে, কীভাবে একটি ভাষা মানুষের অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। লেখক ইতিহাসের পরতে পরতে আমাদের নিয়ে গেছেন এক এমন সময়ের দিকে, যেখানে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং স্বকীয়তা, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। আসামের ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য ইতিহাস, সামাজিক টানাপোড়েন, এবং সংঘাতের চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে বইটি অসাধারণ।
বইটি শুরু হয় আসামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দিয়ে। বহু জাতি-উপজাতি এবং ভাষাভাষীর বৈচিত্র্যময় উপস্থিতির ভেতরে ব্রিটিশ শাসন কীভাবে ক্ষমতার রাজনীতির মাধ্যমে বিভাজন তৈরির বীজ বপন করেছিল, লেখক তা বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। সিলেট এবং গোয়ালপাড়া জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের সূচনা করেছিল, তা এই বইতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ১৯৪৭-পরবর্তী আসামের ভাষানীতি এবং অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা, তার পেছনে থাকা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
লেখকের শক্তি হলো তাঁর বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি। ভাষা-নিপীড়নের ইতিহাস তিনি শুধু তথ্য দিয়ে তুলে ধরেননি, বরং তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, প্রশাসনিক নির্দেশ এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়াগুলোকেও দক্ষতার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথেছেন। গোপীনাথ বরদলৈ, বিমলাপ্রসাদ চালিহা এবং অন্যান্য নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তাঁর আলোচনা ক্ষুরধার। তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে রাজশক্তির প্রশ্রয়ে অসমিয়া জাতিসত্তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে, এবং তাতে বাঙালিরা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।
বইটির আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এর গভীর মানবিক আবেদন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শুধু রক্তপাত আর শোকগাথা নয়, এটি এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের প্রতিরোধের গল্প। ১৯ মে ১৯৬১ সালে শিলচরে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিবরণ, কিংবা বাঙালিদের ওপর বারবার হওয়া আক্রমণ ও দাঙ্গার চিত্র, পাঠকের মনকে ভারাক্রান্ত করে। তবে সেই সঙ্গে আশ্চর্য সাহসিকতারও উদাহরণ দেখা যায়। “জান দিব, জবান দিব না” শ্লোগানের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়।
সুকুমার বিশ্বাসের ভাষা সহজবোধ্য এবং তথ্যবহুল। তবে কিছু জায়গায় ইতিহাসের উপস্থাপনা একটু ভারী মনে হয়েছে, যেখানে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখা একটু চ্যালেঞ্জের হতে পারে। কিন্তু এর পরেও, বিষয়বস্তুর গভীরতা ও গুরুত্ব বইটির পাঠকে এগিয়ে নিয়ে যায়। লেখক আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেন, ভাষা শুধু শব্দের সংগ্রহ নয়, এটি একটি জাতির পরিচয়ের প্রতীক।
সব মিলিয়ে, আসামে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা প্রসঙ্গ শুধু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নয়, এটি এক লড়াইয়ের দলিল। যারা ভাষা, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। বইটি আমাদের শিখিয়ে দেয়, ভাষার জন্য ভালোবাসা আর লড়াই কখনও বৃথা যায় না। এটি সেই কথাই বলে—স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ তখনই পাওয়া যায়, যখন একটি জাতি তার ভাষা এবং সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা করতে পারে।