পরবর্তী এআই এলএলএম দ্বারা চালিত হবে না - রিটন খান
এটা মনে রাখা জরুরি যে AI এর ভবিষ্যৎ শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতির ওপর নির্ভর করে না। মানবিক প্রভাব—AI কীভাবে মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শ্রমবাজারের ওপর প্রভাব ফেলবে—এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ কিছুদিন ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) জগতে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—বড় ভাষা মডেল (LLM) কি তার শীর্ষসীমায় পৌঁছে গেছে? সম্প্রতি অ্যাপল একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, যা সরাসরি না বললেও, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে LLM এর ভবিষ্যৎ হয়তো আর ততটা উজ্জ্বল নয়। যদিও এই মডেলগুলো—যেমন ওপেনএআই-এর GPT-4—বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে তাদের ভাষা উৎপাদন ক্ষমতা, জটিল প্রশ্নের উত্তর প্রদান এবং বিভিন্ন শিল্পে সহায়তার মাধ্যমে, কিন্তু সেই মুগ্ধতার আড়ালে কিছু সীমাবদ্ধতা এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অ্যাপল একাই এমনটি বলছে না। দীর্ঘদিন ধরেই AI বিশেষজ্ঞ গ্যারি মার্কাস সহ অনেকে সতর্ক করে আসছেন যে, LLM-এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।
তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই সতর্কবার্তা সেভাবে কাজ করছে না। ইঁদুর যেমন দল বেঁধে ধেয়ে যায় পাহাড়ের কিনারায়, ঠিক তেমনই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট (VC) রা LLM স্টার্টআপে কোটি কোটি ডলার ঢেলে যাচ্ছেন। ভয়টা হচ্ছে, ‘AI গোল্ড রাশ’ থেকে পিছিয়ে পড়ার। ফলে, বিনিয়োগের ধুম চলছে—মডেলগুলো হয়তো তাদের শীর্ষসীমায় পৌঁছে গেছে, তবু বিনিয়োগকারীরা সে কথা না বুঝেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা বুঝবে যে, LLM-এ আর বিনিয়োগ করা লাভজনক নয়।
LLM থেকে বেরিয়ে আসা
অ্যাপল তাদের গবেষণায় স্পষ্ট করেছে যে, LLM-এর উন্নতি এখন শুধু ধীরে ধীরে হবে, কোনো বিপ্লবী পরিবর্তন আর দেখা যাবে না। LLM গুলো প্রকৃত বুঝতে না পারা, তাদের অস্বাভাবিক শক্তি খরচ, এবং আরও কিছু সীমাবদ্ধতা এখন আরও প্রকট হচ্ছে। তাই AI গবেষকদের একটি বড় অংশ এখন বলছেন যে, আমাদের মনোযোগ LLM-এর বাইরে অন্য কিছুতে দেওয়া উচিত।
LLM-এ পরবর্তী ধাপের বদলে, বিনিয়োগকারীদের উচিত বিশেষায়িত AI সিস্টেম এর দিকে নজর দেওয়া, যা বাস্তব সমস্যার সমাধানে আরও কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবা ও বায়োটেক ক্ষেত্রের AI-এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সিস্টেমের ভাষাগত দক্ষতা ততটা প্রয়োজন নেই, যতটা দরকার বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে প্যাটার্ন খুঁজে বের করা এবং ওষুধের গবেষণায় সহায়তা করা। এ ক্ষেত্রেই AI এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়তে পারে, কারণ এটি সরাসরি মানুষের জীবনে উন্নতির ছাপ ফেলবে।
তেমনই একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে এজ AI, অর্থাৎ, যে AI সিস্টেমগুলো সরাসরি ব্যবহারকারীর ডিভাইসেই কাজ করবে, ক্লাউড নির্ভরতা ছাড়াই। গ্রাহক এবং শিল্প ক্ষেত্রগুলো এখন দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়াকরণের দাবি তুলছে, এবং এজ AI এ ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর হবে। এর ফলে, শক্তি খরচও কমবে এবং তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগও অনেকটা দূর হবে, কারণ তথ্য সরাসরি ব্যবহারকারীর ডিভাইসে প্রক্রিয়াকৃত হবে।
ভবিষ্যতের বিকেন্দ্রীকৃত AI
LLM-এর তুলনায় যা আরও বেশি প্রতিশ্রুতিশীল, তা হলো বিকেন্দ্রীকৃত (Decentralized) AI। ব্লকচেইন এবং AI এখন এমনভাবে একসাথে কাজ করছে, যা AI-কে বিকেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে সাহায্য করছে। এর ফলে, বিশাল ডেটা সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা দূর হচ্ছে এবং AI আরও বেশি শক্তি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য হচ্ছে। বিকেন্দ্রীকৃত এই মডেলগুলো তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাইভেসি সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা কমিয়ে আনবে, যা বর্তমান প্রযুক্তি জগতে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
বিনিয়োগকারীরা যদি আগামী দিনের AI নিয়ে সঠিকভাবে চিন্তা করতে চান, তবে তাদের বিকেন্দ্রীকৃত AI প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করা কোম্পানিগুলোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। LLM ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনে বিনিয়োগের বদলে, এ ধরনের প্রযুক্তি, যা অনেকের সীমাবদ্ধতা দূর করবে, সেখানেই দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই সাফল্য আসবে।
নৈতিক AI: সাময়িক নয়, দীর্ঘস্থায়ী
AI-এর পরবর্তী ধাপ নিয়ে কথা বলতে গেলে নৈতিক (Ethical) AI নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। AI এখন আমাদের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, তার সিদ্ধান্তে পক্ষপাতিত্ব, বৈষম্য এবং স্বচ্ছতার অভাবের বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে। বিনিয়োগকারীদের এখন গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে এমন স্টার্টআপগুলোর দিকে, যারা নৈতিক AI সিস্টেম নির্মাণে কাজ করছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে AI-এর পক্ষপাতিত্বের ঘটনা—চাকরি নিয়োগ, মুখের আদল শনাক্তকরণ এবং বিচার ব্যবস্থার AI ব্যবহারে পক্ষপাতের ঘটনা—এটি স্পষ্ট করেছে যে, নৈতিক AI না হলে তা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। যেসব কোম্পানি AI ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও নৈতিক মান বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারাই দীর্ঘ মেয়াদে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি এবং জনসাধারণের ক্ষোভ এড়াতে পারবে।
মানবিক AI: প্রযুক্তির চেয়েও মানুষ বড়
অবশেষে, এটা মনে রাখা জরুরি যে AI এর ভবিষ্যৎ শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতির ওপর নির্ভর করে না। মানবিক প্রভাব—AI কীভাবে মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শ্রমবাজারের ওপর প্রভাব ফেলবে—এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। AI যতই স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠবে, বিনিয়োগকারীদের উচিত মানবিক (Human Factor)-AI সহযোগিতার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগী হওয়া। এই ধরনের সিস্টেমগুলো মানুষকে প্রতিস্থাপন করবে না, বরং তাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে, এবং এর ফলে আরও সৃজনশীল ও কৌশলগত কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
AI এর পরবর্তী অধ্যায় হবে এমন প্রযুক্তির, যা মানুষকে প্রতিস্থাপন না করে তাদের ক্ষমতা বাড়াবে। যারা এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারবেন, তারাই AI এর ভবিষ্যৎ বিপ্লবের অগ্রদূত হবেন।
বিনিয়োগের সঠিক পথ কী?
LLM তার সীমায় পৌঁছে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পরবর্তী AI এর প্রবাহকে চালিত করবে বিশেষায়িত AI সিস্টেম, এজ AI, বিকেন্দ্রীকৃত AI, নৈতিক AI, এবং মানবিক-AI সহযোগিতামূলক সরঞ্জাম। যারা এ দিকগুলোতে বিনিয়োগ করবেন, তারা বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন এবং পরবর্তী AI বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন।