আমি কে? মানুষ হওয়ার অর্থ কী?
হান কাং লুইজিয়ানা লিটারেচার পডকাস্ট-এ অংশ নিয়েছিলান, সেটির বাংলা অনুবাদ। আমি কে? মানুষ হওয়ার অর্থ কী?
"শিশু বয়স থেকেই, মানুষের ইতিহাসজুড়ে এবং পৃথিবীজুড়ে নৃশংস ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলো আমার কাছে সবসময়ই ভীষণ কষ্টদায়ক মনে হতো।" - হান কাং
হান কাং বড় হয়েছেন গওয়াংজুতে, কোরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় দেড় মিলিয়ন জনবসতির একটি শহর। কয়েক মাস পর, যখন তিনি ও তাঁর পরিবার রাজধানী সিওলে চলে যান, তখন গওয়াংজুতে সামরিক আইন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, যেখানে শত শত ছাত্র গণহত্যার শিকার হয়ে নিহত হয়।
"মানবতার এক বিশাল পরিসর আছে। আমি সবসময়ই এর অর্থ খুঁজে পেতে চেয়েছি"।
এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে, হান কাং কথা বলেন কীভাবে সাহিত্য তাঁর মানুষের প্রতি অবিশ্বাসকে ভেদ করতে সাহায্য করে, এবং তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস দ্য হিউম্যান অ্যাক্টস নিয়েও কথা বলেন, যেখানে ১২ দিনের গণহত্যা যা গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।
যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার বাবা তখন খুব তরুণ একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন। এর মানে হলো, আমরা দরিদ্র ছিলাম, আমাদের বারবার বাসা বদলাতে হতো, আর আমাদের তেমন আসবাবপত্র ছিল না, কিন্তু অনেক বই ছিল। যেন একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, আর বইয়ের মধ্যে থাকা মানে ছিল বইয়ের সুরক্ষায় থাকা, বই দিয়ে ঘেরা থাকা।
আর আমার জন্য, বইগুলো যেন একেকটা জীবন্ত সত্তার মতো। সপ্তাহে সপ্তাহে, মাসে মাসে বইয়ের সংখ্যা বাড়ছিল, যেন এরাই আমার পরিবার। আমি পাঁচটা প্রাথমিক স্কুল বদল করেছি, যা একজন শিশুর জন্য অনেক বড় বিষয়। কিন্তু আমি মনে করতে পারি না যে আমি কোনো কষ্ট অনুভব করেছিলাম, হয়তো আমি সব সময় বইয়ের মধ্যেই সুরক্ষায় বোধ করতাম।
আমি প্রতিদিন বিকেলে বই পড়তাম, যতক্ষণ না বন্ধুরা খেলা করতে আসত। একটা স্মৃতিটা আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। একদিন আমি একটি বই পড়ছিলাম, এবং হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি কিছু দেখতে পারছি না।
কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কী ঘটেছিল? আমি বুঝতে পারলাম যে, চারপাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তখন আলো জ্বালিয়ে পড়া চালিয়ে গেলাম।
এভাবেই বইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়, যা প্রকৃত আনন্দ দিয়েছিল। তারপর, আমার কিশোর বয়সে, সেই সময় সাধারণ কিশোরদের মত প্রশ্নগুলো মনে দানা বাধতে লাগল: আমি কে? এই পৃথিবীতে আমি কী করতে এসেছি? কেন সবাইকে মরতে হয়? কেন মানুষের এত যন্ত্রণা? মানুষ আসলে কী? মানুষ হওয়ার মানেটাই বা কী? তখন, আমি এই প্রশ্নগুলো অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলাম, এবং আমি নতুনভাবে সমস্ত বইগুলো আবার পড়তে শুরু করলাম, লেখকদের প্রশ্নের সঙ্গে আমিও চলতে শুরু করলাম, এবং তখন সবকিছুই নতুন করে ধরা পড়ল।
এক সময় আমি লেখক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম। সেই দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে যখন আমি নিজেকে বলেছিলাম যে আমি একজন লেখক হবো। তখন আমার বয়স ১৪।
আমি শুধু আমার প্রশ্নগুলো লিখতে চেয়েছিলাম, আর সেই বয়সে, যে লেখকরা আমার চারপাশে ছিল, তাদের প্রশ্ন এবং অনুসন্ধানের মধ্যে আমিও ছিলাম। কখনো কখনো তারা হতাশাগ্রস্ত, এবং আমি হতাশ, ক্লান্ত, অসহায় বোধ করতাম। তখন আমি কিছু বাক্য, কিছু কবিতার মতো লাইন লিখতে শুরু করলাম। হয়তো সেগুলো কবিতা ছিল, হয়তো নয়। কখনো কিছু বাকাংশ, কখনো শুধু কিছু শব্দ।
আর আমি তখন ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম। এখনো ডায়েরি লিখি, প্রতিদিন না হলেও, মাঝে মাঝে। তবে তখন সবকিছু এখানেই শেষ হয়নি। আমি তখন গল্প লেখা শুরু করিনি। আমি গল্প লেখা শুরু করি যখন আমার বয়স ছিল ১৯। আর সেটা শুরু হয়েছিল ছোটগল্প দিয়ে।
তারপর আমি একটু বড় গল্প লেখা শুরু করি। আমি কয়েকটি ছোটগল্প সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশ করি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করার পর আমি তিন বছর সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি
আমি আসলে আমার প্রথম উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, তাই আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমার প্রথম উপন্যাস শেষ করতে তিন বছর লেগেছিল। তারপর থেকে আমি উপন্যাস, ছোটগল্প, এবং কবিতা লিখছি।
এমন না যে আমি ঠিক করে বসি কবিতা লিখব। ওগুলো যেন আপনা থেকেই আসে। এমনকি যখন আমি গল্প লিখি, তখনো কবিতাগুলো গল্পের মধ্যেই চলে আসে।
এটা যেন একধরনের হস্তক্ষেপ। হ্যাঁ তাই, ভাষার সঙ্গে আমাকে লড়াই করতে হয়, হয়তো শেষ পর্যন্ত করতেই হবে। আর কিছু প্রশ্ন আছে মনে, যা আমি অনেকদিন ধরেই বহন করছি।
শিশুকাল থেকেই, মানুষকে চেনা আমার জন্য ভীষণভাবে ক্লান্তিকর মনে হত। ইতিহাস জুড়ে এবং পৃথিবীজুড়ে মানুষ যা কিছু করেছে, তা সবই আমাকে ব্যথিত করত। কিন্তু একই সাথে, পৃথিবীজুড়ে কত মর্যাদাবান মানুষও রয়েছে। এগুলো আমার কাছে কঠিন কোন বই পড়ার মতো মনে হত।
এবং আমি যে এই মানব জাতির অংশ, সেটা ভেবেই, যখন আমরা মানবতার ভয়াবহতার মুখোমুখি হই, তখন আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করতে হয়—মানুষ হওয়ার অর্থ কী? জানো তো, মানবতার পরিসর এতটাই বিস্তৃত। আমি সবসময়ই এর অর্থ খুঁজে পেতে চেয়েছি।
হ্যাঁ, এটা যেন এক অন্তহীন অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, কারণ আমি এই পৃথিবীকে এবং জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাই। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আমরা তা পারি না, আর এটা যেন এই দুটি রহস্যের মধ্যে পেছনে-সামনে হাঁটতে থাকা। আমার পুরো জীবনটাই যেন এরকম।
কিন্তু আমার আছে এই এক উপায়, আমার ভাষা, আর এর মাধ্যমেই আমাকে এগিয়ে যেতে হবে। ১৯৮০ সালে, কোরিয়ান উপদ্বীপে নতুন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঘোষিত সামরিক আইনের প্রতিবাদে এক গণঅভ্যুত্থান ঘটে। আর সরকার তাদের বিরোধিতাকারী মানুষদের হত্যা করেছিল। এরপর সেখানে একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে, যা দশ দিন ধরে স্থায়ী ছিল। এর পর সেনাবাহিনী আবার শহরে ফিরে আসে, এবং তারা আবারও হত্যা করে। তাই আমরা একে গণহত্যা বলতেই পারি। আর এটি ছিল একটি জাগ্রত এবং সংহত এক কমিউনিটিকে উৎখাত করা।
আমি গওয়াংজু—এই শহরের নামকে শুধুই একটি নির্দিষ্ট শহর হিসেবে দেখি না। আমার জন্য, এটা যেন মানবতার একটি মৌলিক নাম, যেখানে এই দুটি চূড়ান্ত অবস্থা বিদ্যমান—মহিমা থেকে ভয়াবহতা যা অন্ধকারের তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই আমি যেখানেই থাকি না কেন, যখনই আমরা এই দুই চরম অবস্থার মুখোমুখি হই, সেখানেই আমি গওয়াংজুকে দেখতে পাই।
গাওয়াংজু বারবার ফিরে আসে আমাদের কাছে, আমরা জানি না ঠিক কতজন মানুষ নিহত হয়েছিল। সরকারী তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২০০ জনের মতো, তবে এখনও অনেক নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের কোনো খোঁজ নেই। এই সংখ্যা হাজারো ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি এটা বলতে পারি না, কারণ আমরা সত্যটা জানি না। আমি গওয়াংজুতে জন্মেছি, এবং ১৯৮০ সালে আমার পরিবার গওয়াংজু ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেটা ছিল জানুয়ারি মাস। খুব ঠান্ডা ছিল। আমাদের কাছে সেটা ছিল এক ভীষণ শীতল দিন।
এমনকি আমি তারিখটাও মনে করতে পারি। সেটা ছিল ২৬শে জানুয়ারি। আর আমরা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম কারণ আমার বাবা তাঁর শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন লেখক হওয়ার জন্য। আর তিনি বললেন, এখন আমার আর নিয়মিত কোনো কাজ নেই, তাই আমরা রাজধানীতে গিয়ে থাকি না কেন? এটা ছিল একদম তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত। আমরা চলে গেলাম। আর চার মাস পরে গওয়াংজুতে সেই গণহত্যা ঘটে। তখন পর্যন্ত, গওয়াংজু ছিল স্রেফ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছোট্ট একটি শহর, শান্ত, নিরিবিলি।
হঠাৎ করেই, শহরটির অর্থ একেবারে ভিন্ন হয়ে গেল, এবং সেই গণহত্যার কথা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। আমরা একে অভ্যুত্থান বলতে পারি, আর এটিকে ঐক্যের এক সম্পূর্ণ কমিউনিটি বলতে পারি। আমার পুরো পরিবারের জন্য এটা ছিল এক দীর্ঘ অপরাধবোধের অনুভূতি।
আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই জায়গা ছেড়ে যাইনি, কিন্তু তবুও এমনটাই মনে হত। মনে হচ্ছিল যেন আমাদের জায়গায় অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর সেই অনুভূতি আমার ভেতরে অনেক দিন ধরে ছিল, যদিও আমি কখনো এটা নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করিনি, একদমই না।
আমি এই স্মৃতির সঙ্গেই বড় হয়েছি, যেটা আমি পরোক্ষভাবে অনুভব করেছি, এবং এটা আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে থেকে গেছে। আমার পঞ্চম উপন্যাস শেষ করার পর, আমি ধরতে চাইলাম কেন এই পৃথিবী বা জীবনকে গ্রহণ করা আমার জন্য এত কঠিন। তখন আমাকে নিজের ভেতরে আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হলো।
অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম যে, মানুষের প্রতি এই সন্দেহ ভেদ করতে আমাকে লেখার মাধ্যমে এগোতে হবে। আর সেই কারণেই আমি হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা শুরু করি। এর সব উপকরণ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায়, আমি আরও বেশি ভেঙে পড়ি, কারণ আমাকে সেইসব নৃশংসতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
আমি একটি বিশাল বই পড়েছিলাম, যেখানে ৯০০ জন মানুষের সাক্ষ্য ছিল—যারা বেঁচে ফিরেছিলেন, আহত হয়েছিলেন, বা যারা প্রিয়জন হারিয়েছিলেন। এটা ছিল যেন সব খণ্ডিত অংশগুলো একত্রিত করে তোলা, কারণ আমি এমন একটি শীতল বই লিখতে চাইনি, যেখানে শুধু ঘটনার বিবরণ থাকবে। যত বেশি পড়ছিলাম, ততই আমার বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছিল, এবং এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম যে আমি এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কাজ করছি, যারা মানবিক সহিংসতার মুখোমুখি থেকেও অসামান্য মর্যাদা ধরে রেখেছিলেন। এমন মানুষও ছিলেন যারা একে অপরকে রক্ত দান করেছিলেন, আমি এখনো সেই ছবিটি দেখতে পাই—হাসপাতালের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা রক্ত দানকরছে।
অনেক মানুষের মধ্যে এক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়ে ছিল, যে রক্ত দানের পর বাড়ি ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। তাই আমি মানবতার এই দিকটিকে এবং গওয়াংজুর এই দিকটিকে স্মরণ করতে চেয়েছিলাম। আমি বইটি লেখা শুরু করলাম, আর বই লেখার পুরো প্রক্রিয়ায় আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল একসাথে সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরা, একইসাথে সেই কষ্ট অনুভব করা, এবং নিহতদের জন্য আমার মন প্রাণ উজাড় করে দেওয়া।
আর সম্ভবত এই গণহত্যার অপর প্রান্তে আমি যেটা খুঁজে পেয়েছিলাম, সেটা হয়তো আলো, মানবিক মর্যাদা, বা কী বলব? সবকিছুই বেশ সাধারণ শোনাতে পারে, কিন্তু আমার জন্য এটা ছিল অত্যন্ত বাস্তব। তাই এই বইয়ের মাধ্যমে সেটাই করতে চেয়েছিলাম।
এটা ছিল আমার নিজস্ব রূপান্তরের পদ্ধতি। আমি মানবিক নৃশংসতা থেকে শুরু করেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে যেন এই মর্যাদাবান মানুষদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ভিক্টিম শব্দটি পছন্দ করি না। এটা যেন কোনো প্রকার পরাজয়ের অর্থ দেয়, কিন্তু আমি মনে করি না যে তারা পরাজিত হয়েছিল। তারা পরাজিত হতে অস্বীকার করেছিলবিধায় তাদের হত্যা করা হয়েছিল
তারপর, আমি দ্য হোয়াইট বুক লিখি। সেই বইতে, আমি এমন কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলাম—কিছু যা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা যায় না। এটা আমাদের ভেতরেই আছে। হয়ত আমি এগিয়ে গেছি, এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমিও নিজে বদলে গেছি। তাই এখন আমি ভালোবাসা নিয়ে ভাবছি।
আমি যেন হঠাৎ ভালোবাসার অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আমরা যদি কষ্টটা অনুভব করি, সেটাই আমাদের ভালোবাসার প্রমাণ। ভালোবাসা এখনো ক্লিশে শোনাতে পারে, কিন্তু এটা একইসঙ্গে বাস্তবও।
তাই আমি সবসময় আমার লেখনী শক্তির সাথে এগিয়ে যাই। আশা করি আমি এখনো এগিয়ে চলেছি। হিউম্যান অ্যাক্টস এমন একটি বই যা নিঃসন্দেহে আমাকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে।
আমার পরিবারে আমরা সাহিত্যের আলোচনা করি না। বলতে গেলে, আমরা শুধু পারিবারিক বিষয় নিয়েই কথা বলি। আমি আমার বাবা-মারও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।
আমি তখন বেঁচে থাকা মানুষদের, যারা আহত হয়েছিল বা যারা প্রিয়জন হারিয়েছিল, তাদের সাক্ষাৎকার নিইনি, কারণ আমি তাদের ক্ষত আবারও জাগিয়ে তুলতে চাইনি। আমি বুঝেছিলাম যে আমার কোনো অধিকার নেই তা করার। তাই আমি শুধু আমার আশেপাশের মানুষদের যেমন আমার আমার বন্ধুদের, সহকর্মীদের, এবং আমার বাবা-মা'র সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।
আমাকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছিল। আমি গওয়াংজু নিয়ে যখন বইটি লিখছিলাম, আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘এটা তোমার জন্য কঠিন হবে, কিন্তু আমি চাই তুমি এটি শেষ করো।’ কথাগুলো এখনো আমার মনে রয়েছে।
আমি আশা করি, যারা এই বই পড়বেন, তারা আমার মতোই অনুভব করবেন। আমি আমার বই হিউম্যান অ্যাক্টস থেকে কয়েকটি অধ্যায় পড়ছি।
সেট পরিবর্তনের পর, ধীরে ধীরে আলো আবার উজ্জ্বল হতে থাকে। মঞ্চের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিশের দশকের একটি লম্বা মহিলা, যার সাদা হেম স্কার্টটি শোক পালনকারীদের পরিধানের মতো ঘরোয়া বস্ত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন তিনি নীরবে মঞ্চের বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তখন এটি সংকেত দেয় এক লম্বা, স্লিম কালো পোশাক পরিহিত পুরুষকে, যিনি মঞ্চের পেছন থেকে আবির্ভূত হন।
তিনি তার পিঠে আস্ত একটি কঙ্কাল বহন করে মহিলার দিকে এগিয়ে আসেন। তাঁর খালি পা মঞ্চের তক্তাগুলোর উপর দিয়ে খুব সতর্কভাবে এগুচ্ছে, যেন তিনি ভয়ে আছেন যে কোন সময়ে পা পিছলে যাবে। একদম পুতুলের মতো মহিলাটি এবার ডানদিকে মুখ ফেরান ।
এইবার, যিনি মঞ্চের পেছন থেকে বেরিয়ে আসেন, তিনি ছোট এবং পেটানো গড়নের, যদিও তার কালো পোশাক এবং পিঠে কঙ্কাল বহন করা তাকে প্রথমজনের মতোই অভিন্ন দেখায়। দুজন পুরুষ মঞ্চের বিপরীত প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে, যেন পুরনো কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য, যেখানে প্রক্ষেপণ যন্ত্রের চালক খুব কষ্ট করে হাতল ঘোরাচ্ছেন, আর দৃশ্যগুলো ধীরগতিতে সামনে আসছে। তারা মঞ্চের কেন্দ্রে পৌঁছায়, কিন্তু তারা থামে না। এর পরিবর্তে, তারা সোজা অন্য প্রান্তে চলে যায়, যেন একে অপরের উপস্থিতি স্বীকার করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। ঘরে একটিও খালি আসন নেই। সামনের সারিগুলো মূলত অভিনেতা এবং সাংবাদিকদের রাখা বলে মনে হয়, হয়তো এটি প্রথম রাতের শো।
যখন ইউন সুক এবং বস তাদের আসনের দিকে যাচ্ছিলেন এবং যখন তিনি মঞ্চের সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন, চারজন পুরুষ বিশেষভাবে তার নজরে আসে। যদিও তারা বাকি দর্শকদের মধ্যে মিশে ছিল, তবুও তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে তারা সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ। মিস্টার সিও এখন কি করবেন?
তিনি ভেবেছিলেন। যখন সেই সাদা পোশাকে থাকা পুলিশেরা অভিনেতাদের মুখ থেকে সেন্সরদের কেটে দেওয়া সংলাপ শুনবেন, তখন কি তারা নিজেদের আসন থেকে লাফিয়ে উঠে মঞ্চে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের টেবিলের ওপর দিয়ে বাতাসে ঘূর্ণায়মান সেই চেয়ার, ছেলেটির কপাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা রক্তের ফোয়ারা, ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কারির প্লেট—এইসব যখন মঞ্চে ফুটে উঠবে, তখন প্রযোজনা দলের কী হবে, যারা লাইটিং বক্স থেকে এই দৃশ্য প্রদর্শিত হতে দেখছে?
মিস্টার সিও কি গ্রেপ্তার হবেন? নাকি তিনি পালিয়ে বাঁচবেন, কিন্তু তার জীবন হয়ে যাবে এক পলাতক আসামীর মতো, এমন এক ফরাস্তু ব্যক্তি, যাকে খুঁজে পেতেও তার নিজের পরিবারকে লড়াই করতে হবে? যখন সেই সাদা পোশাকে থাকা পুলিশদের অবয়ব মঞ্চের পেছনের দিকে মিলিয়ে যায়, তাদের পদক্ষেপ স্বপ্নময় শৈথিল্যের সঙ্গে এগিয়ে যায়, তখন সেই মহিলা কথা বলতে শুরু করেন।
অথবা তা মনে হয়। আসলে, তাকে কিছু বলেছে বলা যায় না। তার ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
তবুও, ইউন সুক ঠিকই জানেন তিনি কী বলছেন। তিনি সেই সংলাপগুলো চিনতে পারেন পাণ্ডুলিপি থেকে, যেখানে মিস্টার সিও সেগুলো কলম দিয়ে লিখেছিলেন। সেই পাণ্ডুলিপি, যা তিনি নিজে টাইপ করেছিলেন এবং তিনবার প্রুফরিড করেছিলেন।
তুমি মারা যাওয়ার পর, আমি কোনো শেষকৃত্য করতে পারিনি। তাই আমার জীবনটাই একটানা শেষকৃত্যে পরিণত হলো। মহিলাটি দর্শকদের পিঠ দেখিয়ে ঘুরে দাঁড়ান, আর আসনের মধ্যের দীর্ঘ পথটিতে আলো জ্বলে ওঠে।
এখন, একটি শক্তপোক্ত পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে পথের শেষ প্রান্তে, তার পোশাক জীর্ণ শণবস্ত্র। হাঁটার সময় তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে, সে মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে। পুরুষটির মুখ কঠিন আবেগে বিকৃত হয়ে আছে।
যেন কোনো এক অজানা কিছুর জন্য ব্যাকুলতায় সে দু’টো হাত মাথার ওপর তুলে ধরেছে। তার ঠোঁট শুকনো মাটিতে ছটফট করা মাছের মতো নড়ছে। আবারও, ইউন সুক বুঝতে পারছেন তার ঠোঁট কী বলছে, যেটা তার ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে সেই উচ্চস্বরের চিৎকারকে ভাষণ বলা ঠিক নয় ।
ওহ, আমার কাছে ফিরে আসো। ওহ, যখন আমি তোমার নাম ধরে ডাকব, তখন আমার কাছে ফিরে আসো। আর দেরি করো না।এখনই আমার কাছে ফিরে আসো।
প্রাথমিক বিভ্রান্তির ঢেউ দর্শকদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার পর, তারা নত হয়ে যায় এক নিস্তব্ধতায় এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে অভিনেতার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসনের মাঝের পথের আলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে শুরু করে।
মঞ্চের মহিলাটি আবারও দর্শকদের দিকে ফিরে দাঁড়ান। আগের মতোই নীরবে, তিনি শান্তভাবে দেখেন সেই পুরুষটিকে, যিনি আসনের মাঝের পথে হাঁটছেন, মৃতদের আত্মাদের আহ্বান জানাচ্ছেন।
‘তুমি মারা যাওয়ার পর, আমি কোনো শেষকৃত্য করতে পারিনি।’
এই চোখ, যা একসময় তোমাকে দেখেছিল, একটি প্রার্থনালয়ে পরিণত হলো। এই কান, যা একসময় তোমার কণ্ঠস্বর শুনেছিল, সেটি স্বর্গীয় হয়ে উঠল। এই ফুসফুস, যা একসময় তোমার শ্বাস গ্রহণ করেছিল, সেটিও প্রার্থনালয়ে রূপান্তরিত হলো।
চোখগুলো সম্পূর্ণ খোলা, তবুও যেন জাগ্রত পৃথিবীকে দেখছে না, মহিলাটি শুধু তার ঠোঁট নাড়াচ্ছে আর খালি বাতাসের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। শণবস্ত্র পরিহিত পুরুষটি মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। তার উঁচু করা হাত নেমে আসে, মহিলার কাঁধকে ছুঁয়ে যায়, যেন তুষার সরিয়ে দিচ্ছে।
বসন্তে ফোটা ফুল, উইলো গাছ, বৃষ্টির ফোঁটা আর তুষারকণা—সবই প্রার্থনালয়ে পরিণত হলো। প্রতিদিনের সকাল, যা নতুন দিনকে অভ্যর্থনা জানায়, প্রতিদিনকার সন্ধ্যা, যা অন্ধকার নামায়—সবই প্রার্থনালয় হয়ে উঠল।
বসন্তের ফুল, বার্চ গাছ, বৃষ্টির ফোঁটা আর তুষারকণা—সবই একটি প্রার্থনালয়ে পরিণত হলো।