প্রথমবার ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ পড়ার সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম এটি কোনো সহজ বই নয়। এই বইটি শুধু একটি গল্প নয়; ইতিহাসের অন্ধকার এক অধ্যায়ের দিকে চোখ মেলে তাকানোর আমন্ত্রণ। আমি বইটি পড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। বইটির সম্পর্কে বহু প্রশংসা শুনেছি, কিন্তু সেসব প্রশংসা আমাকে বইটি পড়ার আগ্রহ বাড়ানোর চেয়ে একটা দ্বিধায় ফেলেছিল। আমি কখনোই সহজে হুজুগের পিছনে ছুটতে চাই না—তাই কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। একসময় ঠিক করলাম যে এখন সময় হয়েছে, যখন নিজেকে প্রস্তুত মনে হবে, তখনই শুরু করব।
‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৯৮০ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার গওয়াংজু বিদ্রোহ। ছাত্র এবং সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। (এখন যখন লিখছি তখন ২০২৪ এর বাংলাদেশের জুলাই আগস্টের কথা বারবার মনে পড়ছিল) আর রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ানক: সেনাবাহিনী সরাসরি নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি চালায়, তাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে, বন্দিদের ধরে নিয়ে গিয়ে নানান অত্যাচার করে—এই নিষ্ঠুরতা যেন কল্পনার অতীত।
বইটি পড়তে কষ্ট হচ্ছিল, তবে ভাষার কারণে নয়; বরং এর বিষয়বস্তুর ভারে। হান কাং এই ভয়াবহ ঘটনার কোনো কিছুই গোপন রাখেননি, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এ রকম একটি গল্প পুরোপুরি না বললে, আসলে তার প্রকৃত গুরুত্বটাও ধরা যায় না। উপন্যাসটি ছয়টি অংশে বিভক্ত, প্রতিটি অংশ আলাদা চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত এবং প্রতিটি অংশ সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলে। প্রথম অংশে আমরা পাই ডং-হো নামের এক মাধ্যমিক স্কুলের ছেলেকে, যে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে এবং তার বন্ধু মারা গেছে কিনা, তা জানার জন্য মৃতদেহ খুঁজতে থাকে। এই অশান্ত সময়ের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়, আর সেখান থেকেই গল্পটি বিস্তৃত হতে থাকে।
শুরুতে, উপন্যাসটির গঠন কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে—কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয়, কখনো উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে। কিন্তু লেখার ধারা এতটাই মসৃণ যে, কোনো সময়ই এই পরিবর্তনগুলো অস্বস্তিকর লাগেনি। আমি বইটি মাত্র এক দিনে পড়ে ফেললাম, কারণ এই গল্প থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা সত্যিই অসম্ভব ছিল। হান কাংয়ের ভাষা যতটা সরল, ততটাই গভীর; প্রতিটি শব্দ যেন অত্যন্ত সাবধানে বাছাই করা।
যে দৃশ্যটি এখনো আমার মনে অমলিন হয়ে আছে, তা হলো ডং-হো’র মৃত বন্ধুর আত্মার বর্ণনা, যা নিজের দেহ থেকে পৃথক হতে পারছে না বরং ধীরে ধীরে সে দেহের পচে যাওয়া দেখছে। একটি জায়গায় মৃতদেহগুলোকে ক্রুশ আকারে স্তূপ করা হয়, আর সেই ক্রুশের নিচের দিকের দ্বিতীয় সারিতে আছে তার দেহ। এই দৃশ্যটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে—এটা শুধু শারীরিক মৃত্যুর বর্ণনা নয়, বরং মানুষের মর্যাদা হারানোর এক করুণ চিত্র। মনে পড়ে যাচ্ছে কীভাবে বাংলাদেশে পুলিশ ট্রাকের উপরে ছাত্রদের লাশ স্তূপ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
উপন্যাসটি পড়া যে এতো সহজ ছিল না, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু হান কাং এমনভাবে লিখেছেন যে, প্রতিটি কষ্টের মধ্যেও একটা গভীর সৌন্দর্য আছে। ভাষার সরলতা আর শক্তিশালী প্রতীকী ব্যবহারের মাধ্যমে, তিনি এমন একটি গল্প বলেছেন যা আপনার হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে যাবে। আর অনুবাদক ডেবোরা স্মিথের কাজও প্রশংসার যোগ্য; তার অনুবাদ এতটাই সাবলীল যে, কোথাও কোনো বিচ্ছিন্নতার ভাব মনে হয়নি। বইটির ভূমিকায় স্মিথ একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন যা আমার পড়ার অভিজ্ঞতাকে সাহায্য করেছে। কোরিয়ান ভাষায় “স্মরণ” বা মনে করার অর্থ হল “জেগে ওঠা” (ঘুম থেকে নয়, প্রতিবাদ করে ওঠা)। এই ধারণা—যে অতীত কখনো সত্যিকার অর্থে চাপা থাকে না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার উঠে আসে—গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে। ট্রমার অভিজ্ঞতা যে কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, সেটাই এখানে সবচেয়ে স্পষ্ট।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে, যে তার নিজস্ব ট্রমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিল। সে বলেছিল যে, ট্রমা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা একেবারে সহজ প্রক্রিয়া নয়; পুরোনো স্মৃতি বারবার উঠে আসে, যেমন ছায়া আমাদের প্রতিনিয়ত অনুসরণ করে। আমি তখন সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারিনি তার কথা, কিন্তু ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ পড়ার পর এই ধারণাটি অনেক পরিষ্কার হয়ে উঠল।
এছাড়া, বইটিতে একটি বড় প্রশ্নও তোলা হয়েছে: একটি জাতি কি শুধু তার সরকার দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়, নাকি তার জনগণই আসল জাতি? এমন একটি দৃশ্য আছে যেখানে মৃতদেহগুলোর উপর জাতীয় পতাকা মোড়ানো হয়, আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। অথচ সেই জাতি সেই মানুষদের হত্যা করেছে। এই তীব্র পরিহাস আমাকে একদম স্তব্ধ করে দিয়েছিল। উপন্যাসটি আমাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায়, এবং এই প্রশ্নগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়।
‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ কোনও হেলাফেলা উপন্যাস নয়, কিন্তু এটি এমন একটি উপন্যাস যা আপনাকে ভাবাবে, কাঁদাবে, এবং আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে সমৃদ্ধ করবে। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যে একধরনের চাপা ক্ষোভ নিয়ে আমি এটি পড়ে শেষ করতে পেরেছি। এটি ইতিহাসের এমন একটি অধ্যায়ের ওপর আলো ফেলে যা আমরা অনেকেই জানি না, অন্তত আমি জানতাম না। এটি এমন একটি গল্প যা সময়ের সঙ্গে আরও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠবে।
প্রথম প্রকাশিত বাংলা ট্রিবিউন