নেক্সাস: প্রস্তর যুগ হতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত তথ্য নেটওয়ার্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বইটির শুরুতে হারারি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পাথরের-ফলক রেকর্ড সংরক্ষণ এবং শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বইগুলো গল্প এবং তথ্যকে মৌখিক ঐতিহ্যের সীমার বাইরে নিয়ে গিয়েছিল।
ইউভাল নোয়া হারারি
বই পর্যালোচনা - রিটন খান
নেক্সাস (২০২৪) অন্বেষণ করে তথ্যের নেটওয়ার্ক— গল্প বলার প্রথা এবং প্যাপিরাসের বই থেকে শুরু করে ইন্টারনেট আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত, মানব ইতিহাসকে কিভাবে গঠন করেছে। বইটি তুলে ধরে বর্তমানে প্রযুক্তি এই নেটওয়ার্কগুলোকে কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এবং একইসাথে মানবজাতিকে তথ্য, ক্ষমতা, শৃঙ্খলা এবং সত্য রক্ষার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে।
ইউভাল নোয়া হারারি একজন ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত লেখক, যিনি তার সর্বাধিক বিক্রিত বই স্যাপিয়েন্স: মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং হোমো ডিউস: ভবিষ্যতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তার রচনাগুলো ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং দর্শনের সংযোগস্থল নির্ভর, যেখানে মানব বিবর্তন, প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ এবং আগামীদিনগুলোয় মানবজাতির চ্যালেঞ্জগুলোকে তিনি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি স্যাপিয়েনশিপ নামে একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
বইটির শুরুতে হারারি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পাথরের-ফলক রেকর্ড সংরক্ষণ এবং শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বইগুলো গল্প এবং তথ্যকে মৌখিক ঐতিহ্যের সীমার বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, আর মুদ্রণযন্ত্র জ্ঞানকে গণমানুষের নাগালে পৌঁছে দিয়েছিল, যার ফলে জ্ঞান-বন্টন বিশাল পরিসরে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছিল।
বর্তমানে মানুষ তথ্য বিপ্লবের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে কম্পিউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং ইন্টারনেট আমাদের তথ্য নেটওয়ার্কগুলোকে আমূল রূপান্তরিত করছে। হারারির দৃষ্টিতে এটি আমাদের সামনে বড় দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি করে। প্রথমটি হলো আমরা কি এমন একটি ক্ষমতাকে মুক্ত করেছি যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে? আর দ্বিতীয়টি হলো এই প্রযুক্তিগত ক্ষমতার সম্ভাব্য বিপদগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হবে?
এই প্রযুক্তিগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য, তথ্য ও ক্ষমতার সম্পর্ক গভীরভাবে বুঝতে হবে— নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সত্য ও শৃঙ্খলার ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখা হয়েছে এবং নতুন তথ্য-বিপ্লব কিভাবে তা রূপান্তর করছে। প্রস্তর যুগ থেকে বিটকয়েন পর্যন্ত— নেক্সাস বিশ্লেষণ করে তথ্যের নেটওয়ার্ক কীভাবে ক্ষমতা তৈরি করে এবং এর গুরুত্ব কতটুকু।
১৭৯৭ সালে জার্মান লেখক জোহান উলফগ্যাং ফন গ্যেটে রচিত "দ্য সোর্সারের অ্যাপ্রেন্টিস" কবিতাটি তথ্য ও ক্ষমতার জটিল সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে। যেখানে এক তরুণ জাদুকর-শিষ্য নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টায় নিজের গুরুর মন্ত্র ব্যবহার করে, কিন্তু শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মন্ত্র-চালিত ঝাড়ুকে থামানোর চেষ্টা করলে তা আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, পরিশেষে গুরুকেই এসে সামাল দিতে হয়।
গল্পটি থেকে প্রধানত দুটি শিক্ষা নেওয়া যায়: প্রথমত, ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর মানুষ প্রায়শই তা অপব্যবহার করে, যা মানুষের মনস্তত্ত্বে ক্ষমতার দুর্বলতা প্রকাশ করে। দ্বিতীয়ত, জাদুকর এসে সমাধান করেন, যা বোঝায় নিয়ন্ত্রণহীন শক্তির মোকাবিলায় অতিমানবীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তবে, এই শিক্ষাগুলো ত্রুটিপূর্ণ। যতদিন আমরা "সোর্সারের অ্যাপ্রেন্টিস" মডেলের উপর নির্ভর করব, আমাদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
মানুষ্যজাতি অসংখ্য এমন "জাদুকরী-ঝাড়ু" উন্মুক্ত করেছে— জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট করা, ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি তৈরি, এবং ফ্যাসিবাদের উত্থান। তবুও আমরা বিশ্বাস করি, যেন কোনো এক জাদুকর এসে সবকিছু ঠিক করবে। বাস্তবে, এমন কোনো জাদুকর আসছে না আর সমস্যার সমাধানে একক ব্যক্তি বা একক গোষ্ঠী দ্বারা সম্ভবও নয়। নিয়ন্ত্রণহীন শক্তির আহ্বান আমাদের তখনই ঘটে, যখন আমরা বৃহত্তর নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে সম্মিলিতভাবে কাজ করি।
ধরা যাক, ১৯৩০-এর দশকের জার্মানি। সব জার্মান ফ্যাসিবাদী ছিল না, তবুও একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে তারা সম্মিলিতভাবে হিটলারের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করেছিল। তথ্য সেই নেটওয়ার্ককে সমুন্নত রাখার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে, যা আজকের ডেটার যুগে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানবজাতির তথ্যের অগ্রগতি চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিশু মৃত্যুহার কমানোর মতো উপকার যেমন করেছে —তেমনি তথ্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও আমরা জলবায়ু ধ্বংস, দূষণ এবং সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছি।
আমরা এখন কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা-বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে, অধিক বিধ্বংসী শক্তি উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছি। এই সংকটগুলো একক সত্তার সৃষ্টি নয়, বরং জটিল-তথ্য-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উদ্ভূত। নিজের সুরক্ষার জন্য তথ্য ও ক্ষমতার সম্পর্ক নতুনভাবে ভাবতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে কিভাবে তথ্য-নেটওয়ার্কগুলো কাজ করে, তথ্য কীভাবে সেগুলোতে প্রবাহিত হয়, এবং কিভাবে সেগুলো নিয়ন্ত্রণাধীন করে জাদুকরী-ঝাড়ুগুলোকে সামলানো যায়।
মানুষ ছাড়াও পিঁপড়ে, মৌমাছি, শিম্পাঞ্জি সমাজবদ্ধভাবে কাজ করে, তবে সাম্রাজ্য, ধর্ম বা মতবাদের মতো বিষয়গুলো তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। মানুষের বিশেষত্ব হলো গল্প বলার ক্ষমতা; গল্প বলার মাধ্যমে শুধু ব্যক্তির সাথেই নয়, গল্পের সাথেও সংযোগ স্থাপন করতে পারি। বাইবেল বা কমিউনিজমের মতো গল্প প্রচারের মাধ্যমে অপরিচিতজনও একসাথে কাজ করে, যা নেটওয়ার্কগুলোকে বহুগুণ বিস্তৃত করেছে।
মানবজাতির সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের— রাজা, পোপ বা সম্রাটের ক্ষমতা শুধু তাদের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা থেকে আসেনি, বরং তাদের ধারণ করা শক্তিশালী গল্পগুলো থেকে এসেছে। একইরকম আজকের সামাজিক-যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালীরা লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সংযোগ স্থাপন করেন না; বরং তারা শক্তিশালী, ব্র্যান্ডেড গল্পগুলোর প্রতিফলন, যা তাদের নেটওয়ার্কে বিশাল প্রভাব ফেলে।
হারারি আমাদের তিনটি বাস্তবতার স্তরের কথা বলেন। প্রথমত, বস্তুগত বাস্তবতা— যা অনস্বীকার্য সত্য, যেমন পিজ্জাতে ২,০০০ ক্যালোরি থাকা। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত বাস্তবতা— যা আমাদের অভিজ্ঞতা, যেমন পিজ্জাকে সুস্বাদু মনে করা। তৃতীয়ত, অন্তর্বিষয়ক বাস্তবতা— যা আমরা সম্মিলিতভাবে ভাগ করি, যেমন ২০১০ সালে ১০,০০০ বিটকয়েন দিয়ে পিজ্জা কেনা। সেই সময়ে বিটকয়েনের মূল্য ছিল ৪১ ডলার, যা এখন ৬৯০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিটকয়েনের মূল্য কোনো বস্তুগত সত্য নয়, বরং সম্মিলিত বিশ্বাসের ফল, যা অন্তর্বিষয়ক বাস্তবতার উদাহরণ।
আমরা ভাবতে পছন্দ করি যে আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলার ব্যবস্থা— রাজনীতি ও আইন— কেবল সত্য ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু, এগুলোও ব্যাপকভাবে ভাগ করা গল্পের উপর নির্ভরশীল। যেমন: প্রাথমিক আমেরিকান সমাজ দাসপ্রথাকে ন্যায়সঙ্গত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছিল, এবং সংবিধানও দাসপ্রথা, নারীদের ও আদিবাসীদের অধীনতাকে অনুমোদন করেছিল। রাজাদের ঐশ্বরিক অধিকার বা জাতিরাষ্ট্রের ধারণাও এমন অন্তর্বিষয়ক গল্পের উদাহরণ, যা সম্মিলিতভাবে গৃহীত হয়েছে।
তথ্যের নেটওয়ার্কে ফিরে এসে, সহজভাবে বলা যায়, বেশি তথ্য আরও ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার দিকে নিয়ে যায়। জনতাবাদী ও ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের মতে— তথ্য এমন একটি অস্ত্র যা অবিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু সত্যটি মাঝামাঝি। তথ্যের নেটওয়ার্ক সত্য উদ্ঘাটন (তথ্য) এবং শৃঙ্খলা তৈরির (গল্প) মাধ্যম। যখন নেটওয়ার্ক সত্যকে শৃঙ্খলার উপরে রাখে, এটি অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিতে পড়ে— যেমন ডারউইনের তত্ত্ব খ্রিস্টান সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। আর শৃঙ্খলাকে সত্যের উপরে রাখলে, তা ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু অপব্যবহার—যেমন স্ট্যালিনের রাশিয়া—অনিবার্য হয়।
আজকের দিনে মেটা এবং গুগলের মতো কোম্পানিগুলো নেটওয়ার্কগুলোতে তথ্য সংগ্রহের গতি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। কিন্তু, সর্বোচ্চ দক্ষতার তাড়নায় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করছি; এই নেটওয়ার্কগুলোয় সত্য এবং শৃঙ্খলার ভারসাম্য-রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
মানুষ স্বভাবতই ভুলপ্রবণ, কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজেদের নির্ভুল বলে দাবি করে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টান চার্চের মতবাদ একটি নির্ভুল ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে, যিনি আদম ও ইভের মূল পাপ সংশোধন করেন। তেমনি, মার্কসবাদ শ্রমিক-শ্রেণিকে শোষকদের ভুলভাবে সমর্থন করার বিপদ থেকে পার্টির নির্দেশনার ওপর নির্ভর করে। উভয় ব্যবস্থাই তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে, কারণ তারা মনে করেন অনুসারীরা সঠিকভাবে তথ্যের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয়। তথ্য যদি সহজলভ্য হয়, তাহলে মূল মতবাদ প্রশ্নবিদ্ধ বা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
এই মডেলের বিপরীত হলো তথ্যের মুক্ত-বাজার, যেখানে ভুলগুলো উন্মোচিত হয় এবং সেগুলোকে সত্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। তাত্ত্বিকভাবে এটি আদর্শ মনে হলেও বাস্তবে আরও জটিল। উদাহরণস্বরূপ, গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারকে তথ্য-নেটওয়ার্কের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা যায়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে, ইউরোপে এক হাজার বছরে হাতে লেখা মাত্র ১১ মিলিয়ন গ্রন্থ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু আবিষ্কারের পর মাত্র ৪৬ বছরে ১২ মিলিয়নেরও বেশি মুদ্রিত গ্রন্থ বিতরণ করা হয়েছিল।
এরপর এক গভীর পরিবর্তন আসে। তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং মানুষ দীর্ঘদিনের প্রথাগত মতবাদগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাসের মতো চিন্তাবিদদের ধারণা ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা হয়। এটি ছিল জ্ঞান ও সত্যের এক সোনালী যুগের সূচনা, অন্তত তাই মনে হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এতটা সরল ছিল না। মুদ্রণযন্ত্র তথ্যকে গণতান্ত্রিক করেছিল, কিন্তু তা সত্য ও মিথ্যা উভয় ধরণের তথ্যই ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল।
যখন গ্যালিলিওর চাঁদ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো ছাপাখানার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই আরেকটি লেখা জনপ্রিয়তা অর্জন করছিল: হাইনরিখ ক্রেমারের "ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম" বা "ডাইনিবিধ্বংসী হাতুড়ি," যা ১৪৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ক্রেমার, ডোমিনিকান তদন্তকারী, তার শয়তানী ষড়যন্ত্রের ধারণায় অস্বাভাবিক আসক্তির জন্য চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হন। প্রতিশোধ হিসেবে তিনি এই বইটি লেখেন, যা ডাইনী শিকার পরিচালনার নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ফলে ইউরোপজুড়ে প্রায় ১২,০০০ ডাইনীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়— কিছু গবেষক মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ছিল। ছাপাখানা তথ্যের স্বাধীনতা এনেছিল, কিন্তু তা সত্যের প্রচার বা শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দেয়নি।
সত্যের বিজয় শুধুমাত্র তথ্যের মুক্ত-বাজারের উপর নির্ভর করে না; প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও অপরিহার্য। তবে প্রতিষ্ঠানও ভুল করতে পারে, তাই তাদেরও আত্ম-সংশোধনের প্রক্রিয়া দরকার, যেমন শিশুরা ভুল করে করে হাঁটা শিখে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, চার্চ দাবি করেছিল যে তারা কখনো ভুল করতে পারে না— এই অসম্পূর্ণ আত্ম-সংশোধনের পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। অপরদিকে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষমতা আংশিকভাবে অর্জন করে নিজের ভুল স্বীকার এবং সংশোধনের মাধ্যমে, যা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের আত্ম-উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবে পুরনো তত্ত্বগুলোকে খণ্ডন করে নতুন গবেষণা প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ইউজেনিক্স একসময় ঔপনিবেশবাদ ও গণহত্যার ন্যায্যতা দিতে ব্যবহৃত হলেও, পরবর্তীতে বিজ্ঞান এটিকে খারিজ করেছে। ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার্স (DSM)— যা মনোবিজ্ঞানের "বাইবেল" বলে বিবেচিত হয়— প্রায় প্রতি দশকে নতুন জ্ঞানের আলোকে সংশোধিত হয়, যা ধর্মীয়-গ্রন্থের মতো অপরিবর্তিত থাকে না।
তাহলে কি আত্ম-সংশোধনের প্রক্রিয়াই তথ্যের নেটওয়ার্কে সত্যের ভারসাম্য বজায় রাখার একমাত্র চাবিকাঠি? তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এই প্রক্রিয়াগুলো সত্যের দিকে ভারসাম্য আনতে পারে, তবে প্রায়ই তা শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার মূল্যেও আসে। কখনো কখনো আত্ম-সংশোধন সত্যের কাছে পৌঁছায়, কিন্তু তার ফলে সমাজের স্থিতিশীলতায় আঘাত লাগে, যা জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে।
এবার আমরা ছাপাখানা থেকে আরও এক ঐতিহাসিক মোড়ে পৌঁছাই: কম্পিউটারের আবিষ্কার। ১৯৪০-এর দশকের প্রথম কম্পিউটারগুলো বিশাল এবং মূলত গণিতের জন্য ব্যবহৃত হতো। তবে অ্যালান টুরিং-এর মতো দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখেছিলেন, একদিন এই যন্ত্রগুলো মানব বুদ্ধিমত্তার অনুকরণ করবে। পরবর্তীতে কম্পিউটার, স্মার্টফোন, সামাজিক-মাধ্যম, ব্লকচেইন, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উদ্ভাবনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করেছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকটের সময়ে সামাজিক-মাধ্যমের অ্যালগরিদমের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল গভীর। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর মিয়ানমার গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হলে, ফেসবুক সেখানে প্রবেশ করে এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তথ্যের বাইরে মানুষকে তথ্য শেয়ার ও গ্রহণের সুযোগ দেয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু, গণতন্ত্রের উত্থানের পাশাপাশি, রোহিঙ্গা নামে এক প্রান্তিক জাতিগত সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সহিংসতাও বাড়তে থাকে, যা সামাজিক মাধ্যমের তথ্য প্রবাহের নেতিবাচক দিক প্রকাশ করে।
রোহিঙ্গা সংকটের সময়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির উগ্রপন্থীরা একটি রোহিঙ্গা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হামলা চালালে, প্রতিক্রিয়ায় সরকার ও বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা জাতিগত নিধন শুরু করে। এতে ৭,০০০ থেকে ২৫,০০০ রোহিঙ্গা নিহত এবং ৬০,০০০ জন বাস্তুচ্যুত হয়। এই সংকটে ফেসবুকের ভূমিকা ছিল উদ্বেগজনক। বার্মিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো ভুয়া খবর, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব এবং রোহিঙ্গা-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় ভরে ওঠে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম, যা ব্যবহারকারীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য তৈরি, উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়বস্তুগুলোকে আরও ছড়িয়ে দেয়। ফেসবুকের অ্যালগরিদম এসব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং অটোপ্লে ফিচারের মাধ্যমে উগ্রবাদী ভিডিওগুলো আরও বেশি মানুষ দেখে, যেমন এক সন্ন্যাসীর ভিডিও, যা ৭০% ভিউ পেয়েছিল শুধুমাত্র অটোপ্লের মাধ্যমে, ব্যবহারকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই।
২০১৬-২০১৭ সালের মিয়ানমার সংকট আমাদের সামনে এক জাগ্রত সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় মানুষের পরিবর্তে অ্যালগরিদম তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যা ভয়াবহ ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। আজ আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ও যোগাযোগ করছে। কল্পনা করুন: একটি এআই প্রবন্ধ লিখছে, অন্য একটি সেটি শেয়ার করছে, তৃতীয়টি সেটিকে ভুয়া বলে চিহ্নিত করছে, আর চতুর্থটি সেটিকে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হিসেবে বিশ্লেষণ করছে, এবং পরবর্তী মুহূর্তেই এআই ব্যবস্থা স্টক বিক্রি শুরু করছে— সবই সেকেন্ডের মধ্যে, কোনো মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়াই।
আগের সব তথ্যপ্রযুক্তির তুলনায় আজকের কম্পিউটার অনেক বেশি উন্নত। পাথরের ফলক ট্যাক্সের হিসাব লিপিবদ্ধ করতে পারত, কিন্তু গণনা করতে পারত না; ছাপাখানা বই অনুলিপি করতে পারত, কিন্তু পুনর্লিখন করতে পারত না; রেডিও সঙ্গীত সম্প্রচার করতে পারত, কিন্তু গানগুলো বেছে নিতে পারত না। কিন্তু কম্পিউটার প্রযুক্তি তথ্য-নেটওয়ার্কের কার্যপ্রণালী আমূল বদলে দিয়েছে— তথ্য কীভাবে নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রবাহিত হয় তা ছাড়াও, এটি কীভাবে তৈরি, শেয়ার এবং বিশ্লেষণ করা হয় সেটাও সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করেছে।
প্রথমবারের মতো, আমরা এমন তথ্য-নেটওয়ার্কের মুখোমুখি হচ্ছি যা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম। তাহলে কম্পিউটারের ক্ষমতার ক্ষেত্রে এর অর্থ কী? পুঁজিবাদী সমাজে ক্ষমতা প্রায়শই নির্ভর করে কতগুলি সত্তা আপনার সঙ্গে কাজ করছে, আপনি আইন ও অর্থনীতিকে কতটা দক্ষভাবে বোঝেন, এবং উদ্ভাবনে আপনার ক্ষমতা কতটা। এসব কাজ এখন বা শিগগিরই কম্পিউটার মানুষের চেয়ে ভালোভাবে করতে সক্ষম হবে। যখন কম্পিউটার তথ্য নেটওয়ার্কগুলোকে পুনর্গঠন করছে, তখন তারা আমাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জন করবে।
যদি আপনি কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ বা চীনা বোর্ড গেম গো-এর ভক্ত হন, তাহলে "মুভ ৩৭" শব্দদুটির গুরুত্ব আপনি জানেন। গো এমন খেলা যেখানে খেলোয়াড়রা একটি গ্রিডে পাথর বসিয়ে অঞ্চল দখল করে, দাবার চেয়েও জটিল একটি খেলা। ২০১৬ সালে গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আলফাগো এবং বিশ্বের সেরা গো খেলোয়াড় লি সেডলের মধ্যে ঐতিহাসিক ম্যাচে, আলফাগো এমন একটি চাল দেয় যা সবাইকে হতবাক করে। মুভ ৩৭, এই সাহসী এবং অভূতপূর্ব চালটি শতাব্দীপ্রাচীন কৌশলকে ভেঙে দেয়, যা কেউই প্রত্যাশা করেনি। এই চালই আলফাগোর অসাধারণ উন্নতির পথ উন্মোচন করে।
মুভ ৩৭ শুধুমাত্র এক খেলোয়াড় অন্যজনকে পরাজিত করার ঘটনা ছিল না; বরং ছিল এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ অ-মানবীয় উপায়ে মানুষকে অতিক্রম করল। খেলা দেখছিলেন এমন বিশেষজ্ঞদের জন্য, এটি এক গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল: যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু আমাদের দক্ষতাকেই নয়, আমাদের বুদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গণতন্ত্রের উপর প্রভাবের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণতন্ত্র— তার সব ত্রুটি সত্ত্বেও— সত্য এবং শৃঙ্খলার ভারসাম্য রক্ষায় মানবজাতির সেরা প্রচেষ্টা। ভোটদান এবং বিচারব্যবস্থা বা মুক্ত গণমাধ্যমের মতো প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব কি গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করবে? এটি কেবল তাত্ত্বিক প্রশ্ন নয়—এআই ইতিমধ্যেই বিচার ব্যবস্থায় কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, চাকরির সাক্ষাৎকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। এই প্রক্রিয়াগুলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
AI-এর মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন যেমন উত্থাপিত হয়, তেমনি এটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং জনতার আস্থা কিভাবে পরিবর্তিত হবে তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে। গণতন্ত্র যে তথ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে, AI কি সেই ভারসাম্যকে আরও নড়বড়ে করে তুলছে, নাকি তার নিজস্ব এক নতুন প্রক্রিয়া তৈরি করছে?
এরিক লুমিসের ঘটনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায়বিচার এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। ২০১৩ সালে লুমিস পুলিশকে এড়িয়ে যাওয়ার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন, এবং শাস্তি প্রদানের সময় বিচারক COMPAS নামে একটি এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করেন, যা তার পুনরায় অপরাধ করার সম্ভাবনা মূল্যায়ন করে। এআই-এর মূল্যায়নে লুমিসকে "উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ" হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তবে তার বা তার আইনি দলের কাছে এই মূল্যায়ন কীভাবে করা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। লুমিস এই শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করেন, যুক্তি দেন যে এটি তার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তবুও, আদালত এ শাস্তি বহাল রাখে, যা এআই-এর ব্যবহারের স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে ধরে।
এই ঘটনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব নিয়ে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে—বিশেষ করে যখন AI-এর সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা এবং মানবিক অধিকারগুলির মধ্যে সংঘাত ঘটে। লুমিসের ক্ষেত্রে AI-এর মূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ না থাকায়, এটি আইনি প্রক্রিয়ায় একধরনের অদৃশ্য প্রভাব তৈরি করে, যেখানে প্রযুক্তি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে কিন্তু তা বোঝার বা প্রতিহত করার কোনো উপায় নেই। AI-এর এ ধরনের ব্যবহার কি ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করছে?
এটি একটি গভীর সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে: আমরা প্রায়শই জানি না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে তার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। যখন কোনো AI আপনার ঋণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, এর যুক্তি থাকে একটি "ব্ল্যাক বক্স"-এর মধ্যে, যা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। এমনকি যদি AI কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করে, তা হয়তো হবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জটিল এবং সংক্ষিপ্তভাবে প্রাসঙ্গিক গণনা—যেমন আপনার পেমেন্ট ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে—অথবা কিছু আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক উপাদান—যেমন আপনি কখন আবেদন করেছেন বা আপনার ডিভাইসের ব্যাটারির স্তর। এই অস্বচ্ছতা AI-এর সিদ্ধান্তের ন্যায়বিচার এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে, বিশেষত যখন সিদ্ধান্তগুলো আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিতে প্রভাব ফেলে।
এই পরিস্থিতিতে, আত্ম-সংশোধনের প্রক্রিয়া স্থাপন করা অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে, কারণ আমরা জানি না ঠিক কী সংশোধন করা প্রয়োজন। AI-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ থাকার ফলে প্রযুক্তির প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। স্বচ্ছতা ছাড়া AI শুধু গণনা করে না, আমাদের ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করে, অথচ আমরা সেই গণনার ভিত্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। এই অস্বচ্ছতা আত্ম-সংশোধনের প্রক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তোলে, কারণ সঠিকভাবে ত্রুটি চিহ্নিত করার উপায়ই জানা নেই। প্রযুক্তির উন্নতি এবং ন্যায়বিচারের জন্য, স্বচ্ছতা এবং ব্যাখ্যাযোগ্যতা অপরিহার্য—এটাই আত্ম-সংশোধনের ভিত্তি।
যতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিদ্ধান্তগুলি অস্বচ্ছ হয়ে উঠছে, ততই গণতান্ত্রিক এবং নাগরিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। এই অনিশ্চয়তা জনতাবাদী নেতা, ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক এবং ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বদের জন্য সুযোগ তৈরি করে, যারা জনগণের অসন্তোষকে পুঁজি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। আমরা এর উদাহরণ ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় দেখতে পাচ্ছি—যেমন, কিছু আমেরিকান এখনও ২০২০ সালের নির্বাচনে কে বিজয়ী হয়েছিল সেই মৌলিক সত্য নিয়ে একমত হতে পারছেন না। এই ধরনের বিভাজন এআই-এর অস্বচ্ছ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং জনসাধারণের আস্থার সংকটের সাথে যুক্ত হয়ে আরও গভীর সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
AI কি আরেকটি "জাদুকরী-ঝাড়ু"— একটি নিয়ন্ত্রণহীন শক্তি যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে? আশাবাদীরা, যেমন রে কার্জওয়েল, এই ধারণা অস্বীকার করবেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন AI শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব করবে এবং এমনকি পরিবেশগত বিপর্যয় প্রতিরোধে সহায়ক হবে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের আরও জটিল শিক্ষা দেয়। শিল্প-বিপ্লবের সময় লুডাইটরা ভয় পেয়েছিল যে নতুন প্রযুক্তি কাজের সুযোগ ও সামাজিক শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করবে। যদিও তাদের সব ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়নি, সেই বিপ্লব এমন পরিবেশগত ও মানবিক ক্ষতির সূত্রপাত করেছিল— যেমন জলবায়ু পরিবর্তন— যার প্রভাব আজও আমরা অনুভব করছি। AI-ও একইভাবে আমাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু এর অস্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রণহীন দিক সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি সতর্কভাবে ব্যবস্থাপনা না করা হয়।
ইতিহাসজুড়ে, নতুন প্রযুক্তি মানব তথ্য নেটওয়ার্ককে বারবার পুনর্গঠন করেছে— প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লেখার সরঞ্জাম থেকে শুরু করে, যা কর লিপিবদ্ধ করে নগররাষ্ট্র সংগঠিত করতো, থেকে আজকের কম্পিউটার, যা বিদ্যুতের গতিতে তথ্য তৈরি ও প্রচার করে। তবে, এই নেটওয়ার্কগুলো ক্ষমতা উৎপন্ন করলেও প্রজ্ঞা সবসময় সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের মুক্তির পথ হয়তো এই উপলব্ধিতে রয়েছে: জাদুকরের শিক্ষানবিশের মতো শুধুমাত্র কিছু করার সক্ষমতা থাকলেই তা করা উচিত নয়। সেই ক্ষমতা ব্যবহারের পিছনে প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার প্রশ্ন সবচেয়ে জরুরি।
প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং এর সাথে আসা বিপদগুলোকে উপলব্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। শক্তি ও ক্ষমতার অগ্রগতির সঙ্গে প্রজ্ঞার ভারসাম্য না থাকলে, মানব সমাজে বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এআই এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, আমাদের সেই সূক্ষ্ম সীমা খুঁজে বের করতে হবে যেখানে ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা একসঙ্গে চলতে পারে। শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জনই যথেষ্ট নয়; সেই ক্ষমতার সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রজ্ঞার প্রয়োজন। এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু মানবতার সুরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।
ইউভাল নোয়া হারারির "নেক্সাস" থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মানব ইতিহাস জুড়ে তথ্য নেটওয়ার্কগুলো ক্ষমতা ও জ্ঞানের মধ্যে জটিল সম্পর্ক তৈরি করেছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি এই নেটওয়ার্কগুলোর গঠন এবং রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতিকে বৈপ্লবিকভাবে বদলে দিয়েছে, তবে একই সঙ্গে এটি সত্য ও শৃঙ্খলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার আত্ম-সংশোধনী প্রক্রিয়াগুলোকে দুর্বল করার ঝুঁকিও তৈরি করেছে। এই নতুন বাস্তবতাকে মোকাবেলার জন্য আমাদের গভীরভাবে বুঝতে হবে কিভাবে ক্ষমতা এই নেটওয়ার্কগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাশাপাশি, আমাদের এমন উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে সত্য ও শৃঙ্খলার ভারসাম্য বজায় থাকে এবং প্রযুক্তি মানবতার সেবায় নিবেদিত থাকে।
আশা করি, আপনারা বইটি উপভোগ করবেন। হয়ত ভবিষ্যতে অন্য কোনো বই নিয়ে আবার আলোচনা হবে।