হান কাং-এর দুঃস্বপ্নের উৎস
দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখিকা তার উপন্যাসে বারবার ফিরে যান দেশের রক্তাক্ত অতীতে।
জুডিথ শুলেভিট্স
তরজমা: রিটন খান
এই প্রবন্ধটি ২০২৫ সালের দ্য আটলান্টিক পত্রিকার ফেব্রুয়ারি মুদ্রিত সংস্করণে “হান কাং-এর দুঃস্বপ্নের উৎস” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। Link
২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার উপন্যাসিক হান কাং তার উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জেতেন। এটি ছিল তার প্রথম উপন্যাস যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। উপন্যাসটি এমন এক নারীর গল্প বলে, যিনি হঠাৎ মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন এবং তাকে পাগল বলে গণ্য করা হয়। সমকালীন অবস্থা নিয়ে এটি যেন কাফকার দ্য মেটামরফোসিস বা আ হাঙ্গার আর্টিস্ট-এর একটি আধুনিক রূপ, যেখানে নারীবাদ এবং পরিবেশ রাজনীতির প্রভাব মিশে আছে। অক্টোবর মাসে, তার আরও তিনটি উপন্যাস ইংরেজি সহ ২০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর, সুইডিশ একাডেমি তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। এই সম্মান তাকে বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখকদের উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকদের এই খ্যাতি তাদের একধরনের দুর্বলতায় ফেলতে পারে। সংস্কৃতির গ্লোবাল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর, তারা প্রায়ই শিকড়হীনতা বা তাদের রচনার তীক্ষ্ণতা হারানোর অভিযোগের মুখে পড়েন। হান কাং এখন পর্যন্ত এই অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। তবে দ্য ভেজিটেরিয়ান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার পর, এর ইংরেজি অনুবাদক ডেবোরাহ স্মিথের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি পড়ে। স্মিথ কিছু শব্দ ভুল অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু তার কঠোর সমালোচকরা অভিযোগ করেন যে তিনি হানের স্বচ্ছ, সংযত শৈলী বিকৃত করেছেন, পশ্চিমা পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য এটিকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিতে অনুবাদিত কাজগুলোতে কিছু না কিছু বাদ পড়া বা বিকৃতি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এর মানে এই নয় যে সেগুলো কম প্রামাণিক। তবে হান কাং-এর কাজ বোঝার ক্ষেত্রে অনুবাদের শৈলগত নির্ভুলতা বিচার করার চেয়ে তার কাজের প্রেক্ষাপট গভীরভাবে অনুধাবন করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপট দক্ষিণ কোরিয়ার মতোই—একদিকে সম্পূর্ণ কোরিয়ান, অন্যদিকে অত্যন্ত বিশ্বজনীন।
আঘাতের জাতীয় নিপীড়ন এমনকি আবহাওয়াকেও প্রভাবিত করে। Wuthering Heights-এর পর কোনো কাহিনীতে আবেগপূর্ণ ভ্রান্তি এত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
দ্য গ্লোবাল নোভেল: রাইটিং দ্য ওয়ার্ল্ড ইন দ্য টুইনটি ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইয়ে অ্যাডাম কির্শ বলেছেন, “গ্লোবালিজম শুধু লেখকদের ওপর আরোপিত এক নিয়তি নয়, এটি এমন একটি বিষয় যা লেখকরা দায়িত্ব এবং সুযোগ হিসেবে অন্বেষণ করতে চান।” একটি উপন্যাস গ্লোবাল তখনই হয়, যখন তার লেখক বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড না, হয়ে বরং এমন এক সচেতনতা থেকে কাজ করেন যেখানে সীমান্ত পেরিয়ে থাকার এবং লেখার অভিজ্ঞতাকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। কির্শের সংজ্ঞা অনুযায়ী, হান কাং গ্লোবাল উপন্যাস রচনা করেন। তার অধিকাংশ উপন্যাসই—কখনো সরাসরি, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে—দক্ষিণ কোরিয়ার রক্তাক্ত অতীত, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রদের রাজনীতি এবং কমিউনিজমবিরোধী যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত।
এটি হয়তো শিক্ষামূলক মনে হতে পারে, কিন্তু হানের উপন্যাসগুলোতে ব্যক্তিগত চরিত্রদের সাথে নিয়ে সমৃদ্ধ, সুনির্দিষ্ট কাহিনিই কেন্দ্রে থাকে। তবুও, ইতিহাস সেখানে প্রবেশ করে—বিশেষত যখন সেই ইতিহাস অনেকাংশে বিস্মৃত বা আড়াল করা হয়েছে। এমন ভয়াবহ স্মৃতিগুলো, যা তরুণ প্রজন্মের দক্ষিণ কোরিয়ানরা আর নাম দিতে পারে না, তাদের দেহ ও স্বপ্নে অদ্ভুত লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। কবি হিসেবেও খ্যাত হান তার সাহিত্যিক দক্ষতার অসাধারণ ব্যবহার করেন। তার হাতে জাতীয় স্মৃতি দমন—যা মিলান কুন্দেরা “পরিকল্পিত বিস্মৃতি” বলে অভিহিত করেছেন—এমনকি আবহাওয়াতেও প্রতিফলিত হয়। আবেগপূর্ণ ভ্রান্তি বা pathetic fallacy এত কার্যকরভাবে উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়নি, সম্ভবত Wuthering Heights-এর পর থেকে।
হানের সর্বশেষ উপন্যাস We Do Not Part, যা ই ইয়েওন এবং পেইজ আনিয়াহ মরিস অনুবাদ করেছেন, সেখানে আবহাওয়া একটি বড় ভূমিকা পালন করে, বলা যায় এটি প্রধান চরিত্রের মতোই উপস্থিত। গল্পের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে এক ভয়াবহ তুষারঝড়ের মধ্যে, যেখানে বাতাস, বরফ ও আকাশ এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে। তবে তুষারপাত সবচেয়ে বেশি অর্থবহ। এটি যেন নিজস্ব ক্ষমতা ও অনুভূতি প্রকাশ করে, ভূতগ্রস্ত কোনো সত্তার মতো।
তুষার ঝড়ের মধ্যে বর্ণনাকারীর জরুরি যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। এটি মানুষের চেহারা ও প্রাকৃতিক দৃশ্য এমনভাবে মুছে দেয়, যেন স্মৃতিভ্রংশ অতীতকে মুছে ফেলে। আবার, এই তুষার তাদের মনে এমন সব স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, যা অসহনীয়। তুষার চোখের পাপড়ি ও নাকের উপর বিষণ্ণভাবে লেগে থাকে। এমনকি এটি চোখে প্রবেশ করে গলে গিয়ে অশ্রুতে পরিণত হয়, যেন সে নিজেই কাঁদছে।
We Do Not Part উপন্যাসটি শুরু হয় এক দুঃস্বপ্ন দিয়ে, যা কিউংহা নামের বর্ণনাকারীকে প্রতিদিন রাতেই তাড়া করে এবং আতঙ্কিত করে জাগিয়ে তোলে। স্বপ্নে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন একটি বিস্তীর্ণ সমতলে, যেখানে অসংখ্য কালি-কালো কাটা গাছের গুঁড়ি ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ সমুদ্র উঠে এসে সেই সমতল প্লাবিত করতে শুরু করে। স্বপ্নের নির্দিষ্টতায় তিনি বুঝতে পারেন, এই বিকৃত গাছগুলো আসলে সমাধির চিহ্ন এবং পানি যেন এই কবরগুলোর হাড় তুলে এনে তাদের অপবিত্র না করে। কিন্তু তিনি কীভাবে এই প্লাবন রোধ করবেন?
কিউংহা একজন লেখক, যিনি G— নামে পরিচিত এক শহরে ঘটে যাওয়া গণহত্যা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে হান কাং-এর উপন্যাস Human Acts-এর কথা মনে পড়ে, যেখানে ১৯৮০ সালে গুয়াংজুতে ছাত্র এবং কর্মীদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করতে চরম সহিংসতা চালানো হয়। প্রায় ২,০০০ প্রতিবাদকারীকে (যার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি) কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়। উপন্যাসটি বর্ণনা করে, কীভাবে সেনা ও পুলিশ মৃতদেহগুলো ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গোপনে ফেলে রাখত বা পুড়িয়ে দিত।
G— শহরের ঘটনার ওপর কিউংহার গবেষণা তাকে গভীর বিষণ্ণতায় ফেলে দিয়েছে, এমনকি আত্মহননের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছেন; তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং সম্ভবত তাদের মেয়েকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। এখন তিনি সিউলের বাইরে একটি ছোট ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকেন, যেখানে তিনি কেবল নিজের উইল বারবার লিখে যাচ্ছেন, খাওয়া বা ঘুম কোনোটিই করছেন না। দুঃস্বপ্নের মতোই জীবনের বাস্তবতায়ও তিনি সম্পূর্ণ অসহায়।
কিউংহা তার দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা করেন। তিনি তার বন্ধু ইনসিওনের সঙ্গে, যিনি একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা, একটি আর্ট ফিল্মে কাজ করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা একটি বড় জমিতে অসংখ্য গাছের গুঁড়ি স্থাপন করবেন এবং তারপর শীতের জন্য অপেক্ষা করবেন। তুষারপাত হলে সেটি তারা ক্যামেরায় ধারণ করবেন—“যেন সাদা কাপড় আকাশ থেকে নেমে এসে সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে।”
হান এই স্বপ্ন বা তার প্রতিকারের কোনো ব্যাখ্যা সরাসরি দেন না, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে গাছের গুঁড়ি এবং হাড় G— শহরের দাফনহীন মৃতদের প্রতিনিধিত্ব করে, আর তুষার তাদের জন্য কাফনের মতো কাজ করবে।
হানের উপন্যাসগুলোর শৈলীতে বৈচিত্র্য থাকলেও, সেগুলো একটি অস্বাভাবিকভাবে আন্তঃসংযুক্ত রূপ তৈরি করে। নোবেল পুরস্কার কমিটির একজন সদস্য এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে, “থিমের ধারাবাহিকতায় এটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।” তার সব উপন্যাসেই সাদা রঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ হিসেবে উপস্থিত, যা সাধারণত জন্ম ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত।
হানের সংক্ষিপ্ত, গীতিময় উপন্যাস The White Book—যেখানে বর্ণনাকারীর এক বড় বোনের কথা বলা হয়েছে, যিনি জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান—একটি “সাদা জিনিসের” তালিকা দিয়ে শুরু হয়। এই তালিকার প্রতিটি উপাদানই একটি সংক্ষিপ্ত ধ্যানের বিষয় হয়ে ওঠে। তালিকায় “কাফন” এবং “তুষার” যেমন রয়েছে, তেমনি “সাদা পাখি”ও আছে। We Do Not Part উপন্যাসে তুষারের মতোই এই সাদা পাখিরাও একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
এই উপন্যাসে সাদা জিনিসগুলোকে রূপক বা অশুভ সংকেত হিসেবে পড়ার প্রলোভন এড়ানো কঠিন। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রতীকী ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বিমানের জানালা দিয়ে কিউংহা যখন আসন্ন তুষারঝড়ের দিকে তাকান, তখন তিনি ঘূর্ণায়মান তুষারকে ভুল করে মনে করেন যেন “দশ হাজার সাদা পালকযুক্ত পাখি দিগন্তের ঠিক বরাবর উড়ে যাচ্ছে।” এগুলো যেন Ancient Mariner-এর উপর ভাসমান অ্যালবাট্রস।
কিন্তু সাদা জিনিসগুলো শুধুই প্রতীক হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না। তুষারের মতো সাদা পাখিরাও কাহিনীতে পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করে। ইনসিওন, যিনি কোরিয়ান উপদ্বীপের উপকূলের কাছে জেজু দ্বীপে একা থাকেন, সাদা রঙের দুইটি বাডগিরিগারের (এক ধরনের তোতাপাখি) প্রতি নিবেদিত। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পোষা প্রাণী হলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা ইনসিওনের সঙ্গী। এই পাখিগুলো মানুষের মতো কথা বলে—পাখিদের স্বাভাবিক দক্ষতা—তবে হয়তো এর মধ্যেও আরও কিছু রয়েছে।
কিউংহা এক তুষারঝড়ের মধ্যে উড়ে যাচ্ছেন, কারণ ইনসিওন, যিনি ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার পর মূল ভূখণ্ডের একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়েছেন, তাকে তার দূরবর্তী পাহাড়ি বাড়ি থেকে জীবিত একটিমাত্র বাডগিরিগার উদ্ধার করতে অনুরোধ করেছেন (অন্যটি আগেই মারা গিয়েছে)। কিউংহা নিজেও বিস্মিত যে, তিনি শুধু একটি পাখি বাঁচানোর জন্য এমন বিপজ্জনক যাত্রায় যেতে রাজি হয়েছেন। বিমানে যাত্রার পর, তিনি একটি বাসে ওঠেন, যেখান থেকে তাকে আরেকটি বাস নিতে হবে এবং পরে হাঁটতে হবে ইনসিওনের বাড়ি পর্যন্ত। এ সময় বাতাস আরও শক্তিশালী হয় এবং তুষার ক্রমেই ঘন হয়ে আসে।
কিউংহার জেজু দ্বীপের ভ্রমণটি আসলে একটি মূল কাহিনীর ফ্রেম হিসাবে কাজ করে, যা আরও ভয়াবহ একটি যাত্রার প্রতীক—ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ। ইনসিওনের ব্যক্তিগত ইতিহাস জড়িয়ে আছে জেজু দ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে, যা আবার দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক ইতিহাসের প্রতিফলন। উপন্যাসের অগ্রগতিতে ইনসিওন কিউংহাকে জানান, কীভাবে তিনি তার অতীতকে পুনর্গঠন করেছেন, যা তার মা তাকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছিলেন।
হানের দক্ষতা এখানেই, যেখানে তিনি জীবনের অংশ হিসেবে বিশাল ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অনায়াসে উল্লেখ করেন। রাগান্বিত কিশোরী ইনসিওন, যিনি তার জীবনের সবকিছু—বিশেষত তার ঝুঁকে থাকা, নিরুপায় মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন, একদিন ঘর ছেড়ে সিউলে পালিয়ে যান। সেখানে বরফের নিচে একটি গর্তে পড়ে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হন। কয়েকদিন পর হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে দেখেন, তার মা পাশে বসে আছেন। মা তাকে জানান, তিনি জানতেন কিছু একটা ঘটেছে, কারণ তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন ইনসিওনের মুখে তুষার পড়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ইনসিওন তার মায়ের সেই স্বপ্নের কারণ ব্যাখ্যা করেন: “যখন তিনি ছোট ছিলেন, তখন সৈন্য এবং পুলিশ তার গ্রামের সবাইকে হত্যা করেছিল।” (ইনসিওনের বেশিরভাগ গল্প অনুবাদে ইটালিক্সে লেখা।)
ইনসিওনের মা ও তার বড় বোন অন্য একটি গ্রামে আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন; বাড়ি ফিরে দেখেন, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মৃতদেহ স্তূপ হয়ে পড়ে আছে, আর তুষার সেগুলোর মুখ ঢেকে দিয়েছে। তারা বুঝতেই পারছিলেন না কোনটি তাদের পরিবারের সদস্যদের দেহ। বড় বোন তখন রুমাল বের করে বলেন, “আমি মুখগুলো মুছব, আর তুমি ভালো করে দেখো।”
ইনসিওন বলেন, সেদিনই তার মা, এক শিশুর চোখে, প্রথম শিখেছিলেন যে, যখন মানুষ মারা যায়, তখন তাদের গালে তুষার জমে থাকে, আর একটি পাতলা রক্তমাখা বরফ তাদের মুখের ওপর চুমু খায়।
ইনসিওন তার মায়ের রেখে যাওয়া সূত্র অনুসরণ করতে করতে, যাকে তিনি তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে দেখভাল করেছেন, We Do Not Part এক ধরণের রহস্য এবং ভূতের গল্পে রূপ নেয়। এটি রহস্যময়, কারণ জেজু দ্বীপে যা ঘটেছিল—উপন্যাসে নয়, বাস্তবেই—তা দক্ষিণ কোরিয়ায় খুব কম মানুষই জানে, ঠিক যেমন ইনসিওনও জানতেন না। কোরিয়ান যুদ্ধ শুরুর আগে, সেখানে এক অভ্যুত্থানকে কমিউনিজম বিরোধিতার নামে ভয়ঙ্কর নির্মমতায় দমন করা হয়। ইতিহাসবিদরাও নিশ্চিত নন, সেখানে মৃতের সংখ্যা ৩০,০০০ ছিল, নাকি ৮০,০০০-এরও বেশি, যা প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের জনসংখ্যার মধ্যে ঘটে—গুয়াংজুর তুলনায় আরও ভয়ঙ্কর গণহত্যা।
১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে, জেজু দ্বীপের এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কেউ কথা বলত না, বা মৃত ও নিখোঁজদের সন্ধান করতেও সাহস পেত না, কারণ এটি ছিল এমন এক অপরাধ যা শাস্তিযোগ্য ছিল নির্যাতন ও কারাবাসে।
উপন্যাসে, ইনসিওন জানতে পারেন যে তার নীরব মা কয়েক দশক ধরে, প্রকৃত বিপদের মুখোমুখি হয়ে, মৃতদেহ পুনরুদ্ধার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এই উদ্যোগের পেছনে ছিল তার ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, যার কথা ইনসিওন আগে কখনও শোনেননি।
উপন্যাসটি একটি ভূতের গল্পও, কারণ এখানে জড়িত রয়েছে অতৃপ্ত আত্মাদের উপস্থিতি—প্রথাগত অর্থে যেমন, তেমনি হানের অনন্য কল্পনার ফসল হিসেবেও। কিউংহা যখন ইনসিওনের বাড়িতে পৌঁছান, তখন সেটি জীবনের এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক অদ্ভুত স্থানে স্থগিত বলে মনে হয়। কিউংহা কিংবা পাঠক কেউই নিশ্চিত নন, তিনি কি বাড়ির আগের বাসিন্দাদের আত্মাদের দ্বারা পরিদর্শিত হচ্ছেন, নাকি ইতোমধ্যেই তাদের সঙ্গে পরলোকের জগতে যোগ দিয়েছেন।
বাড়ির বাইরের বাতাস তীব্র শব্দে হাহাকার করছে, তুষার ঝরছে এবং ঝরে পড়ে সব শব্দকে ঢেকে দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারি, প্রকৃতি যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে সেই হাজার হাজার অশান্ত আত্মার কারণে, যাদের কখনো সঠিকভাবে দাফন বা স্মরণ করা হয়নি।
এর বাইরেও, এক বিশাল ছায়ামূর্তি ঘোরাফেরা করছে—যা অনুভবযোগ্য হলেও পুরোপুরি দৃশ্যমান নয়। একে বিশ্ব ইতিহাসের ভূত বলা যেতে পারে। হানের উপন্যাসগুলোতে যুদ্ধাপরাধের তাৎক্ষণিক কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার একের পর এক কর্তৃত্ববাদী সরকার, তাদের সেনা ও পুলিশ বাহিনী; জেজু দ্বীপে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ডানপন্থী সন্ত্রাসীদের দল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন, তখনকার সময়ে দখলদারি শক্তি কারা ছিল। যারা ভুলে যাননি, তাদেরও হয়তো জানা নেই যে এই শক্তি কীভাবে সেই শাসকদের সমর্থন দিয়েছে এবং জেজু সহ অন্যান্য স্থানে কমিউনিজমবিরোধী অভিযান পরিচালনায় অংশ নিয়েছে।
হানের উপন্যাস পড়ার আগে আমি এই ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম জানতাম। আমি জানতাম না যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে, একই বিদেশি শক্তি ৩ লক্ষাধিক কোরীয় সেনাকে কার্যত ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ভিয়েতনামি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। পরবর্তীতে এই যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ কেউ গুয়াংজুর মতো বিদ্রোহ দমনে অংশ নিয়েছিল। এই তথ্যগুলো আমার কাছে এক গভীর ধাক্কা হিসেবে আসে, কারণ যে দখলদারি শক্তির কথা বলছি, তা হল, যুক্তরাষ্ট্র।
হানের স্বভাবসুলভ সূক্ষ্ম ভঙ্গিতে, তিনি পরোক্ষভাবে আমেরিকার অপরাধের প্রতি ইঙ্গিত করেন শুধু The Vegetarian-এ আমরা জানতে পারি যে প্রধান চরিত্রের নির্যাতনকারী বাবা ভিয়েতনামে তার সেবার জন্য একটি পদক পেয়েছিলেন, তবে এর গভীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয় না। Human Acts-এ একটি চরিত্র কোরীয় সেনাদের দ্বারা ভিয়েতনামি গ্রামবাসীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কথা বলে এবং যোগ করে, “যারা আমাদের হত্যা করতে এসেছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতের সেই স্মৃতির সঙ্গেই এসেছিল।”
We Do Not Part-এর একটি লাইনে উল্লেখ করা হয় যে, আমেরিকান সামরিক বিমান জেজু দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের বিনিময়ে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারপত্র ছড়িয়েছিল; কিন্তু যারা আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের তবুও গ্রেপ্তার করা হয়।
এক দেশের মানুষ প্রায়ই বুঝতে পারে না, তারা পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাসের সঙ্গে কতটা জড়িত। হানের উপন্যাসগুলো সরাসরি অভিযোগ তোলে না, বরং তার সূক্ষ্ম উপস্থাপনাই এই ইঙ্গিতকে আরও বিধ্বংসী করে তোলে। তিনি আমেরিকান পাঠকদের এমন সব বিদেশি বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে যান, যা তাদের পূর্বসূরিদের কর্মফল। এরপর তিনি দেন এক সীমিত পরিত্রাণের সুযোগ—নিজেদের উদ্যোগে সেই লজ্জার উত্তরাধিকার আবিষ্কার করার সুযোগ।
সবচেয়ে বড় কথা, হান এই আবিষ্কারের পথ দেখান গল্পের প্রান্ত থেকে, কেন্দ্র থেকে নয়। যেখানে ভিয়েতনামের মতো জায়গায় আমেরিকান হস্তক্ষেপ নিয়ে সিনেমাগুলো দর্শকদের কেন্দ্রে বসাতে চায়, সেখানে হানের উপন্যাস আমাদের দূর থেকে দেখার সুযোগ দেয়। গ্লোবালাইজেশন অনেক খারাপ জিনিসের জন্য দায়ী, তবে হান দেখান, গ্লোবাল উপন্যাস তার মধ্যে পড়ে না।