ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড
যখন সত্য মনের মতো গড়া যায় আর বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত হয়ে ওঠে, তখন গার্সিয়া মার্কেসের জাদুবাস্তবতা যেন আরও তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তার এই সৃষ্টিকর্ম আজও পাঠক ও লেখকদের অনুপ্রাণিত করে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
পর্যালোচনা: রিটন খান
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মাস্টারপিস ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড জাদুবাস্তবতার এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে জাদু আর বাস্তবতার সীমারেখা মিলেমিশে একাকার। মাকন্দো নামক কল্পিত শহরকে কেন্দ্র করে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের গল্প বুনেছে এ উপন্যাস, যেখানে প্রেম, ক্ষমতা, বিচ্ছিন্নতা আর নিয়তির জটিল বাঁধন উঠে এসেছে। শহরের প্রতিষ্ঠা থেকে তার পূর্বনির্ধারিত পতনের গল্পের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের চক্রাকৃতি প্রকৃতি ও মানব অভিজ্ঞতার সার্বজনীনতা অনন্য ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস দ্রুত বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়ে গার্সিয়া মার্কেসকে সাহিত্যিক মহীরুহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ঠাণ্ডা যুদ্ধের (Cold War) আদর্শগত বিভাজনের যুগে, ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড লাতিন আমেরিকার টালমাটাল ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল—উপনিবেশ যুগ থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত। সাম্রাজ্যবাদ, গৃহযুদ্ধ, এবং পরিচয় অনুসন্ধানের সংগ্রাম উপন্যাসটিকে সে সময়ের পাঠকদের কাছে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। এটি লাতিন আমেরিকান সাহিত্য বিপ্লবের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিল, লেখকদের প্রভাবিত করে এবং ইউরোকেন্দ্রিক সাহিত্যভুবনের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজও এর প্রাসঙ্গিকতা অটুট। দ্রুত বৈশ্বিকীকরণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ক্ষয়ের এই সময়ে মাকন্দোর গল্প আমাদের ইতিহাস ও পরিচয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তার তীব্র স্মারক। বুয়েন্দিয়া পরিবারের আবেগ, ট্র্যাজেডি ও নিঃসঙ্গতার যাত্রা আধুনিক সমাজের অস্তিত্ব সংকটকে তুলে ধরে, যেখানে মানুষ একদিকে আরও সংযুক্ত, কিন্তু অন্যদিকে আরও বিচ্ছিন্ন।
যখন সত্য মনের মতো গড়া যায় আর বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত হয়ে ওঠে, তখন গার্সিয়া মার্কেসের জাদুবাস্তবতা যেন আরও তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তার এই সৃষ্টিকর্ম আজও পাঠক ও লেখকদের অনুপ্রাণিত করে, মানবিক আবেগের সার্বজনীনতা আর ইতিহাসের অমোচনীয় চক্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে উপন্যাসের গভীরে প্রবেশের আগে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—এর চরিত্রদের নাম প্রায় একই ধরনের, যা সহজেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রস্তুত থাকতে চাইলে একটি কলম ও কাগজ নিয়ে নামগুলো টুকে রাখুন। প্রস্তুত? তাহলে চলুন, বুয়েন্দিয়া পরিবারের সঙ্গে যাত্রা শুরু করি—এক এমন জাদুকরী ও রহস্যময় গল্পের দিকে, যা আপনাকে বাস্তবতার গভীরতম প্রশ্নে নিমজ্জিত করবে।
আমাদের গল্প শুরু হয় কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার স্মৃতিচারণায়, যেখানে তিনি মাকন্দোর শুরুর দিনগুলোর কথা ভাবছেন। এই নির্জন গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বাবা, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন মাকন্দোতে কদাচিৎ কিছু যাযাবর নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসত, যা গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করত। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এই উদ্ভাবনগুলোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে মেলকিয়াদেস, যাযাবরদের নেতা, থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিমগ্ন হন। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ধীরে ধীরে একাকী হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার স্ত্রী উরসুলা ইগুয়ারান ছিলেন আরও বাস্তববাদী এবং তার স্বামীর আবেগী আসক্তি নিয়ে বিরক্ত। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মাকন্দোকে স্থানান্তরিত করে সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত করার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু উরসুলার এই গ্রাম ছাড়তে অস্বীকৃতিতে তিনি ব্যর্থ হন। এরপর তিনি তার দুই ছেলের দিকে মনোযোগ দেন—হোসে আর্কাদিও, যে পেয়েছে তার বাবার শক্তি, আর অরেলিয়ানো, যে এক রহস্যময় শিশু এবং ভবিষ্যতে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া হয়ে উঠবে। যাযাবরদের (জিপসি) প্রত্যাবর্তনে বরফের মতো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসে, যা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সময়ের সেরা আবিষ্কার বলে ঘোষণা করেন।
এরপর কাহিনী পেছনে ফিরে যায়, যেখানে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও উরসুলার সম্পর্কের সূচনা এবং কাজিন হওয়ায় তাদের সন্তান বিকলাঙ্গ হবে এই ভয়ে উদ্বেগের কথা উঠে আসে। এক প্রতিদ্বন্দ্বী তার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাকে হত্যা করেন। এরপর উরসুলাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, এবং কয়েক মাসের ভ্রমণের পর মাকন্দোর ভিত্তি স্থাপন করেন।
কিশোর বয়সেই হোসে আর্কাদিও, বুয়েন্দিয়া পুত্র, স্থানীয় নারী পিলার তের্নেরার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যিনি পরে গর্ভবতী হন। কিন্তু হোসে এরপর এক জিপসি কন্যার প্রেমে পড়ে এবং তার সঙ্গেই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। উরসুলা তাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন এবং এই সময়ে তার সদ্যোজাত কন্যা আমারান্তাকে গ্রামে ফেলে যান। পাঁচ মাস পরে উরসুলা ফিরে আসেন, এবং তিনি সভ্যতার সঙ্গে মাকন্দোর সংযোগ আবিষ্কার করেন।
পিলার তের্নেরা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখেন আর্কাদিও। এই সময়, এক অনাথ মেয়ে, যার উৎস রহস্যময়, বুয়েন্দিয়া পরিবারে যোগ দেয় এবং তারা তাকে নিজেদের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করে। পরে দেখা যায়, সে অনিদ্রা ও স্মৃতিভ্রংশে ভুগছে, যা দ্রুত পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
স্মৃতিভ্রংশের মোকাবিলায় গ্রামবাসী চারপাশের সমস্ত কিছু চিহ্নিত করে লেবেল লাগিয়ে দিতে শুরু করে। এ সময় মেলকিয়াদেস আবার গ্রামে ফিরে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন অনিদ্রার প্রতিষেধক এবং নতুন এক প্রযুক্তি—ডাগেরোটাইপ, যা রূপার পাতের ওপর ছবি ধারণ করতে পারে। এই উদ্ভাবনে মুগ্ধ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে তার একটি ডাগেরোটাইপ তৈরি করার চেষ্টা করেন।
উরসুলা যখন বুয়েন্দিয়া বাড়ি সম্প্রসারণ করেন, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন আগত এক ম্যাজিস্ট্রেট বাড়িটি কোন রঙে রাঙানো হবে তা ঠিক করার চেষ্টা করেন। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেন। এমনকি সে সৈন্য নিয়ে ফিরে আসলেও, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তার ক্ষমতা খর্ব করতে বাধ্য করেন।
মাকন্দো ক্রমশ আধুনিকায়নের পথে এগোলে, কাহিনী সমাজ পরিবর্তন ও তার প্রভাব তুলে ধরে। গ্রামটি মানবজাতির অগ্রগতির প্রতীক হয়ে ওঠে, যেখানে সমৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাও প্রবল হয়। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ম-কানুনের দ্বন্দ্ব গার্সিয়া মার্কেসের লাতিন আমেরিকান রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি মন্তব্যকে প্রকাশ করে।
এদিকে, নিঃসঙ্গতা একটি পুনরাবৃত্ত বিষয় হয়ে ওঠে। চরিত্ররা মানবসমাজের অতৃপ্ত প্রকৃতির প্রতিক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতায় সান্ত্বনা খুঁজে পায়।
রেমেদিওস কৈশোরে পৌঁছানোর পর অরেলিয়ানোর সঙ্গে বিয়ে করেন। রেবেকার সঙ্গে পিয়েত্রো ক্রেসপির বিয়ে পিছিয়ে যায়, কারণ একটি মিথ্যা চিঠিতে তার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ক্রেসপি চলে যান। ধারণা করা হয়, বিয়ে বিলম্বিত করার জন্য আমারান্তাই চিঠিটি জাল করেছিলেন।
রেমেদিওস বুয়েন্দিয়া পরিবারে প্রাণের সঞ্চার করেন এবং অরেলিয়ানো ও পিলার তের্নেরার পুত্র অরেলিয়ানো হোসেকে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করার দায়িত্ব নেন। বুয়েন্দিয়া পরিবারকে গভীর শোকে আচ্ছন্ন করে বিয়ের কিছুদিন পরই রেমেদিওসের মৃত্যু ঘটে ।
এতে পিয়েত্রো ক্রেসপি ও রেবেকার বিয়ে আরও বিলম্বিত হয়। মাকন্দোর প্রথম গির্জা নির্মাণের সময় বোঝা যায় যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কথিত পাগলামি এতটা গুরুতর নয়। তার অস্পষ্ট বকবক আসলে বিশুদ্ধ ল্যাটিন, যা দিয়ে তিনি অনায়াসে কথা বলতে পারেন।
অন্যদিকে, অরেলিয়ানোর ভাই হোসে আর্কাদিও একজন রুক্ষ ব্যাক্তি রূপে ফিরে আসেন। যদিও রেবেকা পিয়েত্রো ক্রেসপির সঙ্গে বাগদান করেছিলেন, তবু হোসে আর্কাদিওর পুরুষত্ব তাকে মুগ্ধ করে। তাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা বিয়েতে রূপ নেয়। এ ঘটনায় ক্রুদ্ধ উরসুলা তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।
রেবেকার কারণে আগে আমারান্তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত পিয়েত্রো ক্রেসপি ধীরে ধীরে আমারান্তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। রেমেদিওসের মৃত্যুর পর অরেলিয়ানো নিঃসঙ্গতাকে মেনে নেন, কিন্তু শীঘ্রই রক্ষণশীল সরকার ও উদারপন্থী বিদ্রোহীদের মধ্যে আসন্ন যুদ্ধ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রক্ষণশীলদের দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে অরেলিয়ানো উদারপন্থীদের সঙ্গে যোগ দেন।
যুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন, মাকন্দো দখল করে উদারপন্থীদের জন্য জয় নিশ্চিত করেন এবং কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি উদারপন্থী বাহিনীর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু সন্তানের জন্মদাতা হন।
অরেলিয়ানো মাকন্দোর দায়িত্ব হোসে আর্কাদিও ও পিলার তের্নেরার অবৈধ পুত্র আর্কাদিওর হাতে ছেড়ে যান। আর্কাদিও এক নিষ্ঠুর শাসকে পরিণত হন এবং সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের সঙ্গে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান হয়—রেমেদিওস দ্য বিউটি এবং জমজ, অরেলিয়ানো সেগুন্দো ও হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো।
কিন্তু রক্ষণশীলরা মাকন্দো পুনর্দখল করলে আর্কাদিওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, পিয়েত্রো ক্রেসপির বিয়ের প্রস্তাব আমারান্তা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি আত্মহত্যা করেন। যুদ্ধ শেষে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া মানসিক ও আবেগিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এই সময়ে বুয়েন্দিয়া পরিবারের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন, যার মধ্যে রয়েছেন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। কিছু সময় পর কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ও পিলার তের্নেরার পুত্র অরেলিয়ানো হোসে তার খালা আমারান্তার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে। নিঃসঙ্গতায় আমারান্তাও প্রায় সেই সম্পর্ক মেনে নিতে বসেছিল, কিন্তু তাদের প্রায় প্রথম চুম্বনের পরই তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেন।
বিদ্রোহী সেনাবাহিনী থেকে পালানোর পর অরেলিয়ানো হোসে এক রক্ষণশীল সৈনিকের হাতে নিহত হয়, যা আমারান্তাকে ভীষণভাবে বিধ্বস্ত করে। এদিকে কর্নেল বুয়েন্দিয়া মাকন্দোতে ফিরে এসে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা তার কাছে উদারপন্থীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য মনে হয়। আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বেঁচে যান।
উরসুলা যুদ্ধকালীন ধ্বংসস্তূপ থেকে বুয়েন্দিয়া বাড়িকে পুনরুজ্জীবিত করেন। উপন্যাসটি জাতীয় ঘটনাবলির বর্ণনা দিলেও বুয়েন্দিয়া পরিবার ক্রমশ নিঃসঙ্গতায় ডুবে যায়। যুদ্ধ কর্নেল বুয়েন্দিয়াকে মানবিকতা থেকে বঞ্চিত করে তোলে।
পরিবারটি ক্রমাগত ট্র্যাজেডি, রক্তের সম্পর্কের প্রতি নিষিদ্ধ আকর্ষণ এবং বিচ্ছিন্নতায় জর্জরিত হয়। আর্কাদিওর একনায়কতন্ত্র, যার মাধ্যমে গার্সিয়া মার্কেস লাতিন আমেরিকান একনায়কতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন, এবং অরেলিয়ানো হোসের আমারান্তার প্রতি লালসা—এই দুটোই সেই অভিশাপের বহিঃপ্রকাশ।
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার ল্যাটিন প্রলাপ ভাষাকে একটি প্রতিবন্ধকতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। মাকন্দোতে অলৌকিক ঘটনা এবং ট্র্যাজেডি পাশাপাশি বিরাজ করলেও, বুয়েন্দিয়া পরিবার কখনোই করুণা লাভ করে না। শেষ পর্যন্ত, তাদের পতনের মূলে নিহিত থাকে নিঃসঙ্গতার অভিশাপ।
কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তার কর্মশালায় ক্ষুদ্র সোনার মাছ তৈরিতে সময় কাটান এবং রাজনৈতিক আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ান। এদিকে, তার ভাতিজা অরেলিয়ানো মেলকিয়াদেসের জাদুময় সামগ্রী নিয়ে তার ল্যাবরেটরিতে অনুসন্ধান চালান।
অরেলিয়ানো সেগুন্দোর জমজ ভাই হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ধর্মীয় বিশ্বাসে আকৃষ্ট হন এবং মোরগ লড়াইয়ে অংশ নেন। জমজ ভাইরা পেট্রা কোটেসের সঙ্গে একটি রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, যেখানে পেট্রা প্রথমে বুঝতেই পারেন না যে তারা দুইজন আলাদা ব্যক্তি।
হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো যৌন রোগে আক্রান্ত হয়ে পেট্রা কোটেসের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করেন। তবে অরেলিয়ানো সেগুন্দো পেট্রার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাদের এই সম্পর্ক অরেলিয়ানো সেগুন্দোর গবাদি পশুর মধ্যে অতিপ্রাকৃত প্রজননক্ষমতা নিয়ে আসে, যা তার সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে।
খামারের পশুদের উর্বরতা ধরে রাখার জন্য অরিস্টোক্র্যাট ফার্নান্দা দেল কার্পিওকে বিয়ে করার পরও অরেলিয়ানো সেগুন্দো পেট্রার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন । ফার্নান্দা বুয়েন্দিয়া পরিবারের ওপর তার কঠোর নৈতিক নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের টানাপোড়েনের সম্পর্ক সত্ত্বেও ফার্নান্দা ও অরেলিয়ানো সেগুন্দোর দুটি সন্তান হয়—রেনাতা রেমেদিওস, যাকে মেমে নামে ডাকা হয়, এবং হোসে আর্কাদিও (দ্বিতীয়)।
মাকন্দোতে রেল সংযোগ স্থাপিত হলে আধুনিক বিশ্বের দরজা খুলে যায়। বিদেশি পুঁজিপতিরা একটি কলা বাগান এবং একটি দমনমূলক পুলিশ বাহিনী স্থাপন করে। আধুনিক শিল্পপ্রযুক্তির আগমন মাকন্দোর পূর্বের জাদুকরী ও নিরপরাধ পরিবেশকে বিঘ্নিত করে, যা মাকন্দোর শান্ত সরলতার সঙ্গে শিল্পায়নের কঠোর বাস্তবতার সংঘর্ষকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে।
শহরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উরসুলার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়, তবে তিনি পরিচিত রুটিন এবং চারপাশের মানুষের পূর্বানুমানযোগ্য আচরণের ওপর নির্ভর করে মানিয়ে নেন। তিনি এও বুঝতে পারেন, সময় আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। এদিকে, মেমেকে একটি কনভেন্টে (খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী নানদের স্কুল) পাঠানো হয়, যা বুয়েন্দিয়া পরিবারের বাড়ির ক্রমবর্ধমান শূন্যতা ও বিষণ্নতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
মেমে তার ৭২ জন প্রাণবন্ত বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসে যা কিছুদিনের জন্য বুয়েন্দিয়া বাড়ির বিষণ্নতাকে লাঘব করে। তবে পরিবারের ইতিহাস একই ভুলের চক্রে আবর্তিত হতে থাকে। কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ক্রমাগত নিজেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, তার সোনার মাছ তৈরি ও গলানোর কাজ চালিয়ে যান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
গল্পের এই অংশে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে, যেখানে বুয়েন্দিয়া পরিবার অতীতের ভুলের চক্র থেকে বের হতে ব্যর্থ হয়। পুরনো এবং নতুনের সংঘর্ষ রেলপথের আগমনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, যা একসময়ের আদর্শিক মাকন্দোতে আধুনিক শিল্পপ্রযুক্তি নিয়ে আসে। এই পরিবর্তন লাতিন আমেরিকান সমাজের জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আধুনিক উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপনের চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরে। মাকন্দোর জাদু ও মিথের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্ব শিল্পায়নের কষ্টদায়ক এবং অস্বস্তিকর বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়।
এই বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সংগ্রামে, যেখানে তারা অতীতের ভারে জর্জরিত হয়েও দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করে। পরিবারের পুনরাবৃত্ত ইতিহাসের জটিল গঠন বাইবেলের কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে সময়ের সঙ্গে প্রজন্মগুলো আরও দ্রুতগতিতে অতিক্রান্ত হয়। এটি মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি—শৈশব যেন চিরন্তন মনে হয়, অথচ প্রাপ্তবয়স্ক জীবন মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
মাকন্দোর সরলতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বুয়েন্দিয়া পরিবার নিজেদের অতীতের চক্রবদ্ধ ইতিহাসে আটকে পড়ে, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে।
বৃদ্ধ আমারান্তা অতীতে ফিরে যান, নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাপড় সেলাই করেন এবং নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়ে কুমারী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন। উরসুলা তার দৃষ্টিশক্তি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ফার্নান্দা এবং তার নাতনি আমারান্তা উরসুলার সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
মেমে, কলা বাগানের মেকানিক মৌরিসিও বাবিলোনিয়ার প্রেমে পড়েন, যার সঙ্গে সবসময় হলুদ প্রজাপতিরা থাকে। তাদের উত্তাল সম্পর্ক ফার্নান্দার হাতে ধরা পড়ে, এবং এরপর মেমেকে গৃহবন্দি করা হয়। ফার্নান্দা একজন প্রহরী নিয়োগ করেন, যে পরে মৌরিসিওকে গুলি করে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত করে দেয়, তাদের প্রেমের ইতি টেনে দেয়।
মেমে হৃদয়বিদারক দুঃখে বোবা হয়ে যান এবং বাকি জীবনের জন্য কনভেন্টে ফিরে যান, যেখানে তিনি মৌরিসিওর অবৈধ সন্তান অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়ের) জন্ম দেন। এদিকে, হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো গোপনে কলা বাগানের শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের অসহনীয় কাজের শর্তের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে উদ্বুদ্ধ করেন।
সরকার আলোচনার নামে শ্রমিকদের জড়ো করে এবং মেশিনগানের গুলিতে তাদের গণহত্যা করে, এরপর মৃতদেহগুলো সাগরে ফেলে দেয়। হোসে আর্কাদিও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এবং গ্রামবাসীকে এই নৃশংসতার কথা জানানোর চেষ্টা করেন। তবে তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ ততক্ষণে অবিরাম বৃষ্টিতে সব প্রমাণ ধুয়ে মুছে গেছে।
এই বৃষ্টি প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকে, গ্রামকে প্লাবিত করে এবং অরেলিয়ানো সেগুন্দোর গবাদি পশুর সম্পদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।
অরেলিয়ানো সেগুন্দো আবার পেট্রা কোটেসের সঙ্গে মিলিত হন, এবং দারিদ্র্যের মধ্যেও তাদের প্রেম নতুন করে জাগ্রত হয়। উরসুলা বার্ধক্যকে ছাড়িয়ে গিয়ে ১২০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অরেলিয়ানো সেগুন্দো আমারান্তা উরসুলার দায়িত্ব নেন এবং তার ইউরোপীয় শিক্ষার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।
অরেলিয়ানো সেগুন্দো এবং তার ভাই হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো একই সময়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে হোসে আর্কাদিও তার শেষ নিশ্বাসে অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়)কে গ্রামটির ইতিহাস এবং গণহত্যার ঘটনা জানিয়ে যান। কিন্তু কফিনের বিভ্রান্তিতে তাদের দুজনকে ভুল কবরে সমাহিত করা হয়।
উরসুলার উপলব্ধি যে ইতিহাস বারবার নিজেকে পুনরাবৃত্ত করছে, তা এই প্রজন্মের পুনরাবৃত্ত ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে আরও জোরালোভাবে প্রকাশ পায়।
মেমের ভাগ্য তার মায়ের জীবনের প্রতিধ্বনি, আর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বিপ্লবী উদ্দীপনা ও নিঃসঙ্গতা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। এই চক্রাকার প্যাটার্ন বুয়েন্দিয়া পরিবারের ক্রমাগত অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
গার্সিয়া মার্কেস শ্রমিকদের গণহত্যার বর্ণনায় নিরপেক্ষ ভঙ্গি গ্রহণ করেন, যা তার শৈশবে এমন ঘটনার সাক্ষী হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। কলা কোম্পানির শোষণ এবং সরকারের সহযোগিতামূলক ভূমিকার কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টি একদিকে মৃত শ্রমিকদের জন্য একটি প্রতীকী বাইবেলীয় শোক হিসাবে ধরা যেতে পারে, অন্যদিকে এটি কলা কোম্পানির ঈশ্বরসুলভ ক্ষমতার প্রতীক, যা গণহত্যার স্মৃতি সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলার ক্ষমতা প্রকাশ করে।
মাকন্দোর ক্রমাগত স্মৃতিভ্রংশ এবং অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে, যেখানে উরসুলা বার্ধক্যে জ্ঞান হারান, অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) গ্রামটির স্মৃতি এবং গোপন ইতিহাসের একমাত্র অভিভাবক হয়ে ওঠেন। তার গণহত্যার বিবরণ সরকারী বিবরণের বিপরীতে অবস্থান নেয়, যা উপন্যাসের বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণের গভীরতা প্রকাশ করে। মাকন্দোতে বাস্তবতা একটি পরিবর্তনশীল এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন অর্থবাহী কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়।
অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) মেলকিয়াদেসের পুরনো ল্যাবরেটরিতে নিজেকে গুটিয়ে নেন। মাঝে মাঝে মেলকিয়াদেসের আত্মা তাকে দেখা দেয় এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোর রহস্য বোঝার ইঙ্গিত দেয়, যা কেবল ১০০ বছর পূর্ণ হলে উন্মোচিত হবে।
দারিদ্র্যে জর্জরিত বুয়েন্দিয়া পরিবারকে গোপনে খাবার পাঠিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়ের) প্রাক্তন উপপত্নী পেট্রা কোটেস। এদিকে, আর্কাদিওর বিধবা সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ, যিনি দশকের পর দশক ধরে পরিবারের যত্ন নিয়েছেন, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বুয়েন্দিয়া পরিবারকে চিরতরে ত্যাগ করেন।
এর কিছুদিন পর ফার্নান্দা দেল কার্পিও মারা যান, তার আরিস্টোক্র্যাটিক অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে। ফার্নান্দার পুত্র হোসে আর্কাদিও (দ্বিতীয়) বহু বছর পর ফিরে আসে এবং প্রকাশ করে যে সে কখনো সেমিনারিতে পড়াশোনা করেনি; বরং উত্তরাধিকারের অপেক্ষায় সময় কাটিয়েছে।
উরসুলার লুকানো সোনা তার ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে খুঁজে পেয়ে হোসে আর্কাদিও এটি মদ্যপান ও শহরের তরুণদের সঙ্গে পার্টিতে অপচয় করে। একাকী অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়ের) সঙ্গে এক বন্ধন গড়ে ওঠার পর, সেই তরুণ বন্ধুরাই বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যা করে এবং অবশিষ্ট সোনা চুরি করে।
আমারান্তা উরসুলা ইউরোপ থেকে তার বেলজিয়ান স্বামী গ্যাস্টনের সঙ্গে ফিরে আসেন, নতুন করে বাড়ি ও শহর পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন নিয়ে। তবে, মাকন্দোর পতন যেন আর থামানো অসম্ভব।
অরেলিয়ানো দ্বিতীয় আমারান্তা উরসুলার প্রেমে পড়েন, এবং তারা এক নিষিদ্ধ সম্পর্ক শুরু করেন। গ্যাস্টন এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তাদের ছেড়ে চলে যান। অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) ও আমারান্তা উরসুলার একটি পুত্রসন্তান জন্মায়, যার পেছনে শূকরের মতো লেজ থাকে—উরসুলার দীর্ঘদিনের রক্তসম্পর্কিত বিয়ের ভয় সত্যি প্রমাণিত হয়।
আমারান্তা উরসুলা প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে মারা যান। শোকে ডুবে অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) মদ্যপানে আশ্রয় নেন এবং শিশুটিকে ভুলে যান। পিঁপড়ায় খেয়ে শেষ হয়ে যাওয়া শিশুটিকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে বুয়েন্দিয়া পরিবারের বংশ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়।
অবশেষে অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) মেলকিয়াদেসের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পাঠোদ্ধার করেন এবং আবিষ্কার করেন যে, সেগুলোতে মাকন্দোর প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সর্বনাশ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস বিবৃত রয়েছে। যখন তিনি সেগুলো পড়েন, তখন একটি সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় মাকন্দোকে ধ্বংস করে দেয়।
উপন্যাসটি পূর্ণচক্রে ফিরে আসে, যেখানে আমারান্তা উরসুলা ও অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়ের) রক্তের সম্পর্ক একটি অভিশপ্ত সন্তানের জন্ম দেয়, যা পরিবারের চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে আনে। শিশুটির শূকরের লেজ উরসুলার দীর্ঘদিনের রক্তের সম্পর্ক নিয়ে শঙ্কার শারীরিক প্রতিফলন এবং পরিবারের সঙ্কুচিত চরিত্রের চিহ্ন।
অরেলিয়ানো (দ্বিতীয়) যখন মেলকিয়াদেসের পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার করেন, সময় ও বাস্তবতা এক হয়ে যায়। পাঠক বুঝতে পারে, এই পাঠ আসলে ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রতিচ্ছবি যা মাকন্দোর ইতিহাস এবং পরিবারের পতন এক অনিবার্য চক্রে বন্দি ছিল।
মেলকিয়াদেস গার্সিয়া মার্কেসের প্রতিরূপ হয়ে ওঠেন, যিনি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে অতীত ও ভবিষ্যৎকে সংরক্ষণ করেন, ঠিক যেমন মার্কেস মাকন্দোকে গড়ে তোলেন কলম্বিয়ার ইতিহাসের প্রতিফলন হিসেবে। মাকন্দো এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ, যেখানে বুয়েন্দিয়া পরিবার মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের ধ্বংস এক প্রলয়ংকরী সমাপ্তির প্রতীক, যা প্রতিটি সভ্যতার জন্য অপেক্ষা করে থাকা চক্রাকার ইতিহাসের ফাঁদে আটকে থাকে।
বুয়েন্দিয়া পরিবার, মানবজাতির মতোই, একই চাকার সঙ্গে বাঁধা, যা ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না তাদের ইতিহাসের ভার তাকে থামিয়ে দেয়। এটি সভ্যতার উত্থান-পতনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে অতীতের পুনরাবৃত্তি শেষ পর্যন্ত ধ্বংসকে অনিবার্য করে তোলে।
বুঝতে পারলেন? চলুন এবার গল্পের প্রধান বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরি। One Hundred Years of Solitude বুয়েন্দিয়া পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠিত মাকন্দো গ্রামের উত্থান-পতনের গল্প। প্রথমে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা মাকন্দোতে যাযাবরদের (জিপসি) আগমন ও নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিবর্তন শুরু হয়।
পরিবারের প্রধান হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তার গবেষণা এবং দুই পুত্র—হোসে আর্কাদিও ও অরেলিয়ানো—এর ভবিষ্যৎ নিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বুয়েন্দিয়া পরিবারের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো—জন্ম, মৃত্যু, প্রেম এবং ব্যক্তিগত রূপান্তর—গল্পের ধারায় উন্মোচিত হয়।
পরিবারের পুরুষরা আবেগপ্রবণ ও বুনো থেকে শুরু করে অন্তর্মুখী ও চিন্তাশীল বৈচিত্র্যে পূর্ণ, আর নারীরা—উচ্ছ্বল মেমে থেকে সংযত ফার্নান্দা দেল কার্পিও—পরিবারের সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। তাদের পার্থক্যের মাঝেও মাতা উরসুলা ইগুয়ারান পরিবারকে একতাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন।
মডার্নিটির চ্যালেঞ্জ মাকন্দোতে আসে কলা বাগানের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের সূচনার প্রতীক। এর ফলে ভূমি ও মানুষের শোষণ শুরু হয়, যা মাকন্দোর অবক্ষয়ের পথ উন্মোচিত করে।
যখন শ্রমিকরা শোষণের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করে, সেনাবাহিনী তাদের নির্মম গণহত্যা চালায়। এরপরে শুরু হয় পাঁচ বছরের অবিরাম বৃষ্টি, যা মাকন্দোর পতনের প্রতীক হয়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ভাগ্য মাকন্দোর মতোই অধঃপতনের দিকে অগ্রসর হয়।
উপন্যাসের শেষ অধ্যায়গুলোতে একটি ক্ষয়িষ্ণু শহর ও পরিবারের চিত্র ফুটে ওঠে, যেখানে বুয়েন্দিয়ারা রক্তের সম্পর্কের চক্রে বন্দি এবং বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। গল্পের সমাপ্তি হয় পরিবারের শেষ সদস্যের শঙ্কাজনক আবিষ্কারের মাধ্যমে, যা প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণীতে লেখা ছিল। তাদের জীবন ছিল পূর্বনির্ধারিত, এক জটিল বুনন, যা সৌন্দর্য ও বেদনার মিশ্রণে পূর্ণ, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের বিখ্যাত জাদুবাস্তবতার বৈশিষ্ট্যে রঙিন।
আমার এই বয়ান যদি আপনাদের এতটুকু ভালো লেগে থাকে তাহলে মন্তব্য ও সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।
ধন্যবাদ
হ্যাপি রিডিং।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (১৯২৭–২০১৪) ছিলেন এক অগ্রণী কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, চিত্রনাট্যকার ও সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যজগতের “বুম” আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” এবং “কলেরার সময়ের প্রেম,” আর তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোট উপন্যাস হলো “কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না” এবং “একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর ইতিহাস।” ১৯৮২ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।