স্মার্টফোন কি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে?
আমরা বরং ডিজিটাল কন্টেন্টের প্যাসিভ ভোক্তায় পরিণত হয়েছি, যা আমাদের স্ক্রিনের সাথে যুক্ত রাখার জন্য তৈরি। আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছি না কি স্মার্টফোন আমাদের ব্যবহার করছে, সেটি ভাবার সময় এসেছে।
আজকের আধুনিক সমাজে একটা ক্ষীণ গুঞ্জন চলছে যা হয়তো অনেকেই খেয়াল করছেন। সেই গুঞ্জনের আওয়াজ হলো একটানা নোটিফিকেশনের টোন, প্রথমে এসব কিছুই নির্দোষ মনে হলেও, একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে প্রশ্নটা উঠতেই পারে: আমরা কি আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি?
আমাদের অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোনে ভিডিও দেখছি, যেটা কখনো মজার ক্লিপ, আবার কখনো দীর্ঘ আলোচনার ভিডিও। কিন্তু একবার একটু পিছনে তাকিয়ে দেখুন, আমরা যতোটা সময় এই ভিডিওগুলোর পিছনে ব্যয় করছি, সেটা হয়তো আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, আমরা বেশিরভাগ সময় কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়াই দেখছি। আবার অনেকে শুধু সময় কাটানোর জন্যই দেখছি, অলস মুহূর্তগুলো পার করার জন্য বা হয়তো এমন কিছু থেকে দূরে থাকতে, যা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যারা প্রযুক্তির উপর গভীর জ্ঞান রাখেন, তারা অনেকেই এ বিষয়ে চিন্তিত। স্টিভ জবস, যিনি স্মার্টফোন বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ, বিশ্বাস করতেন মনোযোগের শক্তিতে, কিন্তু আজ আমরা তার সৃষ্টির এক বিরাট সম্ভাবনাকে কেবল মজার ভিডিও দেখার জন্য ব্যবহার করছি। স্মার্টফোন কি এ জন্যই তৈরি হয়েছিল?
এই প্রযুক্তির পিছনের অনেকেই আজ চোখ কপালে তুলছেন। জ্যারন ল্যানিয়ার, যিনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একজন অগ্রগামী এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সমালোচক, তিনি প্রকাশ্যে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছিলেন, "এ সব কোম্পানি আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে। তারা তোমাকে এমন কনটেন্ট দেখায়, যা তোমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনে আটকে রাখবে। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়।" তাহলে কি আমরা সত্যিই এই ভিডিওগুলো দেখার জন্য স্বেচ্ছায় বেছে নিচ্ছি, নাকি কেউ আমাদের এর সাথে যুক্ত রাখার জন্য প্রযুক্তির ফাঁদ পাতছে?
সত্যি বলতে, এই ধরনের শর্ট ভিডিও দেখা একরকমের বিনোদন মনে হলেও, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আমাদের কর্মক্ষমতা এবং মানসিক সুস্থতার ওপর নিঃসন্দেহে মারাত্মক। একাধিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত স্মার্টফোন এবং স্ক্রিনের সময় আমাদের মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক সম্পর্কের মানও নষ্ট করে। তাহলে এর প্রকৃত মূল্য কী? আমরা হয়তো সময় দিচ্ছি, কিন্তু এর বিনিময়ে হারাচ্ছি আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—সময়, যা কখনো ফিরে আসে না।
যদি আপনি ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা ভাবেন, তখন এগুলোকে কর্মক্ষমতার যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। স্মার্টফোনকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল এমন একটি ডিভাইস হিসেবে, যা আমাদের জীবনকে সহজতর ও কার্যকর করবে। কিন্তু আজকের ২০২৪ সালে, আমরা সেই অসাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি সময় কাটানোর জন্য, অর্থহীন ভিডিও দেখার জন্য। টিম বার্নার্স-লি, যিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবিষ্কারক, তিনি একবার ইন্টারনেটের সম্ভাব্য অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন, "ওয়েব হলো সৃজনশীলতার জন্য খোলা জায়গা, কিন্তু এটা এমন একটি জায়গাও হয়ে উঠতে পারে যেখানে আমরা নিজেরাই হারিয়ে যেতে পারি"। স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে কি আমরা সেই জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি না?
ভাবুন একবার, ইউটিউবের অগণিত ভিডিও না দেখে আমরা হয়তো নতুন কিছু শিখতে পারতাম, বাস্তব জীবনে অন্যদের সাথে গল্পে আড্ডায় সময় কাটাতে পারতাম, অথবা এমন কিছু শখের কাজে মনোনিবেশ করতে পারতাম যা আমাদের জীবনে প্রকৃত আনন্দ এবং পূর্ণতা আনতে পারে। অথবা আমার মত শুধু বই পড়ে। কিন্তু আমরা বরং ডিজিটাল কন্টেন্টের প্যাসিভ ভোক্তায় পরিণত হয়েছি, যা আমাদের স্ক্রিনের সাথে যুক্ত রাখার জন্য তৈরি। আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছি না কি স্মার্টফোন আমাদের ব্যবহার করছে, সেটি ভাবার সময় এসেছে। ইভান স্পিগেল, স্ন্যাপচ্যাটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, একবার বলেছিলেন, "আমাদের পুরো সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আমাদের সময়কে কাজে লাগাতে হবে কিছু গঠনমূলক কাজের জন্য।" অথচ তিনিই আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করালেন? আমাদের মূল্যবান সময়টা কি আমরা সত্যিই কাজে লাগাচ্ছি?
একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, প্রযুক্তি নির্মাতারাও তাদের নিজস্ব পণ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। শোনা যায়, অনেক সিলিকন ভ্যালির উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের স্ক্রিন টাইম সীমিত রাখছেন। তাদের এই আচরণ কি ইঙ্গিত করছে যে তারা এমন কিছু নিশ্চয়ই জানেন যা আমরা জানি না। যদি প্রযুক্তির স্রষ্টারাই তাদের ব্যবহার কমিয়ে দেন, তবে আমাদেরও কি আমাদের ব্যবহার পুনর্বিবেচনা করা উচিত নয়?
প্রকৃত সত্য হলো, আমরা বেশিরভাগ সময় স্মার্টফোনে কেবল সময় নষ্ট করছি। এর বদলে আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দরকার। হয়তো এখনই সময়, ফোনটা কিছুক্ষণের জন্য পাশে রেখে, বাস্তব জীবনের দিকে মনোনিবেশ করার।
অনলাইনে একটা ভুল উক্তি বেশ জনপ্রিয়, যা আইনস্টাইনের নামে চালানো হয়। উক্তিটি ভুলভাবে আইনস্টাইনের নামে প্রচারিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই যে আইনস্টাইন এই কথাগুলি কখনও বলেছিলেন বা লিখেছিলেন। কিন্তু উক্তিটি যেই করে থাকুন কথাটি এই লেখার সাথে সংগতিপূর্ণ; "আমি সেই দিনের ভয় করি যখন প্রযুক্তি আমাদের মানবিক সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যাবে। পৃথিবীতে তখন শুধুমাত্র নির্বোধদের একটি প্রজন্ম থাকবে।" আমরা কি প্রতিদিন স্মার্টফোনে বেশি সময় কাটিয়ে সেই দিনের আরো কাছে পৌঁছে যাচ্ছি না?
প্রশ্ন হলো, আমরা আর কতটা সময় হারাবো, আমাদের সামনে থাকা বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার আগে? কতটা অপচয়ের পর হুশ ফিরবে? প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।