মোমবাতি জ্বেলে পড়ি পোপের আত্মজীবনী
ধর্ম মানুষের জীবনে ঈশ্বর বা স্বর্গের প্রতিশ্রুতি না দিলেও তাকে পুণ্য, পবিত্রতা, পরমানন্দ এবং শান্তি প্রদান করে। প্রকৃত ধর্ম হলো পরোপকার, আর পরপীড়ন হলো পাপ।
মোমবাতি জ্বেলে পড়ি পোপের আত্মজীবনী
রিটন খান
যদি আমি মানুষের বা স্বর্গীয় ভাষায় কথা বলি,
কিন্তু আমার মধ্যে ভালোবাসা না থাকে,
তাহলে আমি শুধু এক প্রতিধ্বনিত ঘন্টা
বা ঝনঝন শব্দ তোলা করতালের মতো।
— প্রথম করিন্থীয় পত্র ১৩:১
পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী Hope: The Autobiography, রিচার্ড ডিকসনের অনুবাদে, প্রকাশ করেছে ভাইকিং।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাটি এখনো কানে বাজে, ‘ঈশ্বরের কোন কার্য না আশ্চর্য'। এই কথাটিই বারবার ফিরে এসেছে পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী হোপ-এ। পোপের আত্মজীবনী পড়া কেন? এখানে আমার আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। তবু পড়ছি কারণ আত্মকথা হয়ে ওঠে বাস্তবের দলিল। যে অধ্যায়টি আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি সেটি হলো, ২০২৪শে জি৭ সামিটের তাঁর A. I নিয়ে বক্তৃতা। বক্তৃতার অনুবাদটি এই লেখাটির শেষে যুক্ত করা হয়েছে।
পোপ ফ্রান্সিস হলেন প্রথম লাতিন আমেরিকান, যিনি ক্যাথলিক চার্চের পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন। ৮৮ বছর বয়সে পোপ ফ্রান্সিস আধুনিকতম ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক পোপ। আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণকারী জর্জ মারিও বার্গোগ্লিও ১৯৬৯ সালে পুরোহিত হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি বুয়েনোস আইরেসের আর্চবিশপ হন এবং ২০০১ সালে কার্ডিনাল পদে উন্নীত হন। ২০১৩ সালে তাঁর পূর্বসূরি পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের পদত্যাগের পর, তিনি ক্যাথলিক চার্চের ২৬৬তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে বড় অস্ত্রোপচার এবং হাঁটুর ক্রমাগত সমস্যার কারণে তাকে হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভর করতে হলেও, তিনি অবসর নেওয়ার কোনো ইঙ্গিত দেননি। বরং, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তার আত্মজীবনী, যা মূলত মৃত্যুর পর প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেটি ২০২৫ সালে রোমান ক্যাথলিক গির্জার জন্য ঘোষিত জুবিলি (একটি ক্যাথলিক পবিত্র বর্ষ, যা ২০২৪ সালের বড়দিনের প্রাক্কালে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের এপিফানি দিবসে সমাপ্ত হবে) বর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকাশ করা হবে। বর্তমান পোপের লেখা প্রথম স্মৃতিকথা হিসেবে Hope প্রকাশকদের জন্য এক স্বপ্নের ব্যাপার।
বইটি ২০১৩ সালে ফ্রান্সিসের পোপ নির্বাচনের পেছনের সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরে। এতে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে আর্জেন্টিনায় ইতালীয় অভিবাসীদের নাতি জর্জ বেরগোগলিও এক বৃহৎ পরিবারের পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। ফুটবল আর ট্যাঙ্গোর প্রতি তার ভালোবাসা (যা তিনি “এক আবেগময়, আন্তরিক সংলাপ, যা দূর অতীতের গভীর শিকড় থেকে এসেছে” বলে বর্ণনা করেন), রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন, এরপর যিশু সমাজে যোগদান এবং পুরোহিত হওয়ার কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। পেরোনিজমের সঙ্গে তার সাময়িক সম্পর্ক এবং আর্জেন্টিনার সামরিক শাসনের প্রতিকূলতাও বইটিতে উঠে এসেছে। অবশেষে, বুয়েনস আইরেসের কার্ডিনাল আর্চবিশপ হওয়ার পর, অবসর পরিকল্পনা করার মুহূর্তেই, বেড়েডিক্ট ষোড়শ পদত্যাগ করেন এবং তার উত্তরসূরি হিসেবে বেরগোগলিওকে নির্বাচিত করা হয়।
বইটিতে উঠে এসেছে, ধর্ম মানুষের জীবনে ঈশ্বর বা স্বর্গের প্রতিশ্রুতি না দিলেও তাকে পুণ্য, পবিত্রতা, পরমানন্দ এবং শান্তি প্রদান করে। প্রকৃত ধর্ম হলো পরোপকার, আর পরপীড়ন হলো পাপ। শক্তি ও সাহসিকতা ধর্মের চিহ্ন, অন্যদিকে দুর্বলতা ও কাপুরুষতা পাপের প্রতীক। স্বাধীনতায় রয়েছে ধর্মের মহিমা, আর পরাধীনতায় পাপের পরিচয়। অন্যকে ভালোবাসাই ধর্ম, আর ঘৃণায় লুকিয়ে থাকে পাপ। পোপের এই আত্মজীবনী ক্যাথলিক গির্জার প্রভাবশালী এক নেতার সম্মুখীন চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর অনন্য অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, তবে কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।
যেকোনো পোপ নির্বাচনী প্রক্রিয়া—যা সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র (Conclave) দেখলে বোঝা যায়—সবসময়ই নাটকীয়। তবে ২০১৩ সালের পোপ নির্বাচন ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০৫ সালে বেড়েডিক্ট ষোড়শ নির্বাচিত হওয়ার সময় বেরগোগলিও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও, বেশিরভাগ মানুষ তা ভুলে গিয়েছিল বা ধরে নিয়েছিল যে কার্ডিনালরা তরুণ কাউকে নির্বাচন করবেন, ভেবেছিল যে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে আসা বেরগোগলিও নির্বাচিত হবেন না।
তবে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে শুরু না করে, ফ্রান্সিস তার স্মৃতিকথা শুরু করেন তার দাদাদাদি এবং বাবার ১৯২০-এর দশকে ইতালি থেকে আর্জেন্টিনায় অভিবাসনের কাহিনি দিয়ে। যে জাহাজে তাদের উঠার কথা ছিল, যা পরে ডুবে যায়।
পোপ ফ্রান্সিস জানাচ্ছেন, তাঁর জীবনের বই হলো আশার (hope) এক যাত্রার গল্প, এমন একটি যাত্রা যা তাঁর পরিবার, জনগণ, এবং সর্বশক্তিমানের সকল মানুষের থেকে আলাদা করে কল্পনা করাও অসম্ভব। বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি অনুচ্ছেদে, এটি সেইসব মানুষের গল্পও, যারা তাঁর সঙ্গে এই পথ পাড়ি দিয়েছে, যারা পূর্বে সাথে থেকেছে, এবং যারা ভবিষ্যতেও থাকবে।
আত্মজীবনী কেবল আমাদের ব্যক্তিগত গল্প নয়; এটি সঙ্গে বহন করা এক বোঝা। স্মৃতি শুধু যা আমরা মনে রাখি তা নয়, বরং যা আমাদের ঘিরে থাকে। এটি শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও কথা বলে। পোপ বলছেন মেক্সিকান এক কবির ভাষায়, স্মৃতি হলো এমন এক বর্তমান, যা কখনো পেরিয়ে যায় না। মনে হয়, এটি যেন গতকালের ঘটনা, অথচ এটি আসলে আগামীকালের।
তিনি শুধু এটাই বোঝাতে চান যে, পারিবারিক ইতিহাসের মাধ্যমে অভিবাসীদের সংগ্রাম ও ট্র্যাজেডির সঙ্গে নিজের সংযোগ স্থাপন করেন। এই সহানুভূতিই তার পোপ দায়িত্বকে গড়ে তুলেছে, এবং তিনি নিয়মিতভাবে অভিবাসন নিয়ে নানান দেশের সরকারগুলোর হৃদয়হীনতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। Hope বইয়ে ক্রিশ্চান দায়িত্বের বার্তা বারবার উঠে এসেছে—অভিবাসী থেকে শুরু করে পরিবেশগত ধ্বংস, দারিদ্র্য বা তার কথায় “উদাসীনতার বিশ্বায়নের” শিকারদের জন্য যত্ন নেওয়া। তিনি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “এ কথাটি মনে রাখুন, শান্তি কখনোই দেয়াল তৈরির মাধ্যমে আসবে না”।
মানুষ প্রায়ই বলে, "অপেক্ষা করো এবং আশা করো"—এমনই যে স্প্যানিশ ভাষায় esperar শব্দটির অর্থ দুইটাই: "আশা করা" এবং "অপেক্ষা করা"। কিন্তু আশা আসলে গতিশীলতার গুণ, পরিবর্তনের ইঞ্জিন। এটি এমন এক টান, যা স্মৃতি এবং ইউটোপিয়াকে একত্রিত করে আমাদের স্বপ্নগুলো সত্যি গড়ে তোলে। আর যদি কোনো স্বপ্ন মলিন হয়ে যায়, তবে আমাদের স্মৃতির অঙ্গার থেকে আশা নিয়ে তা নতুন আকারে আবার স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন।
তবে এই স্মৃতিকথায় অনেক বিষয়ই বিরক্তিকর এবং অস্বচ্ছ। বইয়ের মাঝামাঝি অংশে ফ্রান্সিস তার পোপ নির্বাচনের কাহিনি এবং তার পূর্বসূরি বেড়েডিক্ট ষোড়শকে দেখতে যাওয়ার একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেখানে একটি ছবি রয়েছে, যেখানে তারা দুজন একটি বড় সাদা বাক্সের দুই পাশে বসে আছেন। সেই সময়ে বাক্সের ভেতরে কী থাকতে পারে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল, তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। ফ্রান্সিস স্মৃতিচারণ করেন, বেড়েডিক্ট তাকে বলেছিলেন, “সবকিছু এখানেই আছে।” এরপর তিনি লেখেন যে, বাক্সটিতে “যৌন নিপীড়ন, দুর্নীতি, গোপন লেনদেন এবং অপকর্ম সংক্রান্ত নথি” ছিল। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি।
ফ্রান্সিস পোপ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেও কেলেঙ্কারিগুলো থেমে থাকেনি। তিনি এড়িয়ে গেছেন ২০১৮ সালের সেই বিতর্ক, যখন তিনি চিলিতে যৌন নিপীড়ন গোপন করার অভিযোগে অভিযুক্ত এক বিশপকে নিজের সঙ্গে মিসা পালনে অনুমতি দিয়েছিলেন (উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট বিশপ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন)। একইভাবে, তিনি ব্যাখ্যা দেননি কীভাবে তিনি ২০১৮ সালের আগে আমেরিকান কার্ডিনাল থমাস ম্যাক্যারিকের বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন, যদিও ভ্যাটিকানে সেগুলো নিয়ে রিপোর্ট করা হয়েছিল।
এবং কেন—যিনি তালাকপ্রাপ্তদের প্রতি সহানুভূতির কথা বলেছেন, সমকামীদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন এবং সাধারণ সদস্যদের গির্জার কাজে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন অথচ নারী পুরোহিতদের অনুমোদন দিতে রাজি নন? গির্জার পরিচালনায় নারীদের ভূমিকা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এগিয়ে যেতে হবে,” কিন্তু তাদের পুরোহিত হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেন না।
পোপ বলছেন, খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের জানা উচিত, আশা কখনো ঠকায় না, কখনো হতাশ করে না। সবকিছু জন্মায় এক চিরন্তন বসন্তের ফুল হয়ে ফুটতে। “অবশেষে, আমরা শুধু এটুকুই বলব: আমি এমন কিছুই মনে করতে পারি না, যেখানে তুমি (ঈশ্বর) নেই।” হে ঈশ্বর, তোমার মায়ার ঐশ্বর্য চাই না, কেবল তোমাকেই চাই।
এই বইয়ে অনেক বিষয় বাদ পড়লেও, এটি এমন এক মানুষের গল্প, যিনি কখনো বিষণ্ণতায় ভুগেছেন, ঐতিহ্যবাদী ও উদারপন্থীদের মধ্যকার সংঘাত মোকাবিলা করেছেন, পৃথিবীর সমস্যা ও মানবজাতির ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থেকেও আশাবাদী। এই আশা তার বিশ্বাসের ভিত্তি। তিনি আমাদের সময়ের একজন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি, তবুও তার মধ্যে এক সাধারণ মানুষের ছোঁয়া রয়ে গেছে। বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি রসিকতা করে উল্লেখ করেন যে জাস্টিন ওয়েলবি তাকে একবার বলেছিলেন, “একজন লিটার্জিস্ট আর একজন সন্ত্রাসীর মধ্যে পার্থক্য কী? সন্ত্রাসীর সঙ্গে অন্তত আলোচনা করা যায়।”। তিনি জানেন যে আশাবাদী ও বিশ্বাসের মতো হাস্যরস মানবদুঃখের প্রতিষেধক। তিনি বলেন, “আমরা আগামীকালের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়তে পারি না, আমাদের তা নির্মাণ করতে হবে।”
বইটি পড়া শেষ হলে দীর্ঘ আলোচনার ইচ্ছে রয়েছে। এখন শুধু হোপ পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হচ্ছে কি হবে দিবা-আলোকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার।
হ্যাপি রিডিং…
A. I পোপ ফ্রান্সিস বক্তৃতা ২০২৪
তরজমা: রিটন খান
কোনো সন্দেহ নেই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব একটি প্রকৃত বৌদ্ধিক-শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে, যা যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থার নির্মাণে অবদান রাখবে। এই চমকপ্রদ—এবং একইসঙ্গে ভীতিকর—উপকরণের ব্যবহার কোন পথে এগোবে, তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। এটি অন্যান্য যেকোনো প্রযুক্তির চেয়ে বেশি জটিল, কারণ এটি নির্ধারিত কাজের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং প্রয়োজনমতো এমনভাবে ডিজাইন করা যেতে পারে, যাতে এটি মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
গার্ডিনির ভাষায় বলতে হয়, যেকোনো প্রযুক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান একমাত্র মানুষের দ্বারাই সম্ভব। একটি নতুন ধরণের মানবতা তৈরি করতে হবে, যা গভীর আধ্যাত্মিকতা, নতুন ধরনের স্বাধীনতা এবং অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সমৃদ্ধ হবে।
জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত কোনো অ্যালগরিদমের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি মানব চিন্তার বিকাশ বা তথ্যের প্রকৃত স্বরূপও নয়। ইতিমধ্যেই তথ্যকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে একধরনের বৌদ্ধিক দূষণের সঙ্গে, যার মধ্যে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ডিপফেক—এক ধরনের কৃত্রিম চিত্র ও কণ্ঠস্বর যা বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু আদতে মিথ্যা। এমনকি আমিও একবার এর শিকার হয়েছি।
আরও বৃহৎ পরিসরে দেখলে, স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়, যখন মানুষ স্বার্থপরতার প্রলোভনে পড়ে, মুনাফার লোভে আত্মনিয়োগ করে, এবং ক্ষমতার তৃষ্ণায় অন্ধ হয়ে যায়।
আমরা কি তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে নতুন বর্ণ ব্যবস্থার সৃষ্টি করব, যা শোষণের নতুন রূপ নিয়ে আসবে? নাকি নিশ্চিত করব যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে এবং মানুষের বহুবিধ চাহিদার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে?
এটি কি ধ্বংস এবং মৃত্যুর নতুন পথ হয়ে উঠবে, আমাদের যুদ্ধের উন্মত্ততায় আরও বেশি অসাড় করে দেবে? নাকি আমরা এটিকে ন্যায়বিচার, উন্নয়ন এবং শান্তির উপকরণে পরিণত করব?
এই প্রশ্নগুলো আমাদের যত্ন সহকারে লালন করতে হবে। এগুলোকে স্থান দিতে হবে, প্রাণবন্ত করতে হবে, যাতে এই প্রশ্নগুলিই আমাদের দায়িত্বশীল ও সচেতন হওয়ার পথ দেখায়।
মানুষদেরকেই ঠিক করতে হবে, তারা কি অ্যালগরিদমের খাদ্য হয়ে উঠবে, নাকি নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে নিজের পথেই এগিয়ে যাবে। সেই পথের মূলে রয়েছে মানুষের হৃদয়—প্রত্যেক মানুষের অন্তরের গভীর কেন্দ্রবিন্দু। আমার চতুর্থ এনসাইক্লিক্যাল Dilexit nos—যেখানে আমি মানব ও খ্রিস্টের হৃদয়ের ঐশ্বরিক ভালোবাসার কথা লিখেছি—তাতে উল্লেখ করেছি, মনে হচ্ছে বিশ্ব সমাজ তার নিজের হৃদয় হারিয়ে ফেলছে।
যখন আমরা দাদীদের শোক দেখে অসহিষ্ণু বোধ করি না, তখন সেটি একটি হৃদয়হীন পৃথিবীরই লক্ষণ। এমন দৃশ্য বহুবার, বহু যাত্রায়, বহু শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে আমাকে স্তম্ভিত করেছে—এক পৃথিবী, যা বিধ্বংসী সংঘাতে বিদীর্ণ। শোকে কাতর দাদীরা, যাঁরা তাঁদের মৃত নাতি-নাতনির জন্য বিলাপ করছেন, অথবা ভয়, যন্ত্রণা, ও গৃহহীনতার মধ্যে আশ্রয়হীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের এই লজ্জার মুখোমুখি হতে হবে।
পৃথিবী বদলাতে পারে কেবল হৃদয়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে, কারণ, দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল আমাদের শিখিয়েছে, পৃথিবীর যে ভারসাম্যহীনতা আজ বিদ্যমান, তা অনেক দূর অতীত থেকে এসেছে এবং আধুনিক তরল সমাজে আরও গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতা আসলে মানবতার গভীরে গড়ে ওঠা এক গভীর বিভাজনের ফল।
ডিজিটাল জগতে কার্যরত অ্যালগরিদম প্রমাণ করে যে আমাদের চিন্তা ও ইচ্ছার সিদ্ধান্ত অনেক বেশি প্রচলিত, সাধারণ এবং মানসিকভাবে সংজ্ঞায়িত, যা আমরা হয়তো কল্পনাও করিনি। কিছু মাত্রায় এগুলো সহজেই অনুমানযোগ্য এবং একইসঙ্গে সহজেই প্রভাবিতযোগ্য। কিন্তু আমাদের হৃদয়ের ক্ষেত্রে তা নয়। আমরা আমাদের হৃদয় দিয়েই পরিচিত, কারণ সেটিই আমাদের স্বতন্ত্র করে, আমাদের আধ্যাত্মিক পরিচয়ের ভিত্তি নির্মাণ করে এবং অন্য মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
হৃদয়ই একমাত্র সক্ষম আমাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসকে একত্রিত ও সুরেলা করতে, যা হাজারো টুকরোয় বিভক্ত। কিন্তু ‘বিরোধী হৃদয়’ অর্থাৎ স্বার্থপরতা ও আত্মমুগ্ধতায় নিমজ্জিত দৃষ্টিভঙ্গি এক ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করে, যা শেষে উদাসীনতা, হতাশা এবং “ইচ্ছার বিলোপ” ঘটায়, কারণ অন্য মানুষ দিগন্ত থেকে হারিয়ে যায়।
ফলে আমরা ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ি, কারণ হাইডেগারের মতে, ঈশ্বরীয়তাকে স্বাগত জানানোর জন্য আমাদের একটি “অতিথিশালা” তৈরি করতে হয়—নিজেদের জন্যও, যাতে আমরা আমাদের প্রকৃত ও গভীর সারমর্মের প্রতি সাড়া দিতে পারি। যদি হৃদয় সজীব না থাকে, গার্ডিনি দস্তয়েভস্কির জগৎ নিয়ে তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, “মানুষ নিজের কাছেই অচেনা রয়ে যায়।”
কোনো অ্যালগরিদম কখনোই আমাদের সেই শৈশব স্মৃতিগুলো ধারণ করতে পারবে না, যেগুলো আমরা ভালোবাসা এবং যত্নে সংরক্ষণ করি। স্মৃতির সেই দৃশ্যগুলো, যা আমাদের মনের সিন্দুকে ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু প্রতিবারই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে—একটি সুগন্ধ, বা পুরোনো কোনো গানের সুরের সাথে। আমি মনে করি আমার নোনার কথা, যিনি আমাকে কাঁটাচামচ দিয়ে এম্পানাডার প্রান্ত সিল করতে শিখিয়েছিলেন; মায়ের সাথে রেডিওর সামনে কাটানো সেই বিকেলগুলো, যেগুলো ছিল খেলার আর শেখার মাঝামাঝি এক মুহূর্ত; বাবার মুখের সেই হাসি, যখন আমি কোনো মজার মন্তব্য করতাম; অথবা আমার বোন মারিয়া এলেনার জন্ম নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা; একটি পড়ে যাওয়া পাখির ছানার যত্ন নেওয়ার মুহূর্ত; কিংবা গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে “ভালোবাসে/ভালোবাসে না” বলে গুনগুন করার দিনগুলো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, আমরা ভুলতে পারি না যে মানবতাকে রক্ষা করার জন্য কবিতা আর ভালোবাসা অপরিহার্য। এগুলো শৈশবের মতোই, পৃথিবীর লবণস্বরূপ—যদি এর স্বাদ হারিয়ে যায়, তবে পৃথিবী কেবল পচন আর ক্ষয়ের এক নির্জীব আকারে রূপান্তরিত হবে, যেমনটি এক ফরাসি লেখক সতর্ক করেছিলেন। যখন হৃদয়ের স্বতন্ত্রতা উপেক্ষিত হয়, আমরা সেই উত্তরগুলো হারাই যা কেবল বুদ্ধিমত্তা দিতে পারে না; আমরা অন্যদের সঙ্গে মেলবন্ধন হারাই, আমাদের ইতিহাস আর ব্যক্তিগত গল্পগুলোও হারিয়ে যায়। কারণ প্রকৃত ব্যক্তিগত অভিযাত্রা হলো সেটি, যা হৃদয় থেকে সম্পন্ন হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখব, এইটুকুই আসল সত্য।
আমাদের ভবিষ্যতের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়া উচিত নয়, বরং সেটিকে নির্মাণ করতে হবে। এটি আমাদের সবার দায়িত্ব যে আমরা এমনভাবে ভবিষ্যত গড়ে তুলি, যা ঈশ্বরের প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ—যার মূলে রয়েছে মানবজাতির সুখ, মানুষের কেন্দ্রীয় অবস্থান, এবং কারও প্রতি কোনো বৈষম্য ছাড়াই সকলের অন্তর্ভুক্তি।
পরিবর্তনের এক নতুন যুগের সূচনালগ্নে, আমি সবাইকে জন পল দ্বিতীয়ের ২০০০ সালের জুবিলির সময় উচ্চারিত কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে চাই: "ভয় পেও না। খ্রিস্টের জন্য দরজা উন্মুক্ত করো!" আর যদি কখনো ভয় ও উদ্বেগ তোমাদের গ্রাস করে, তাহলে যোহনের সুসমাচারের সেই ঘটনার কথা মনে করো—কানার বিবাহের উৎসব (যোহন ২:১–১২)—এবং নিজেকে বলো: সেরা মদ এখনো পরিবেশিত হয়নি (The best wine has yet to be served.)। এই ছবিটি আমি বিশেষভাবে মূল্যবান মনে করি, কারণ আমি নিজে কৃষক পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম।
এটি নিশ্চিত মনে রাখো: আমাদের জন্য, আমাদের প্রিয়জনদের জন্য, সবচেয়ে গভীর, আনন্দময় এবং সুন্দর বাস্তবতা এখনো আসেনি। এমনকি কোনো পরিসংখ্যান যদি এর বিপরীত কথা বলে, কিংবা ক্লান্তি তোমার শক্তি হ্রাস করে, তবু এই অজেয় আশা কখনো হারিয়ো না।
এই কথাগুলো দিয়ে প্রার্থনা করো, আর যদি প্রার্থনা করতে না পারো, তবে নিজেকে মৃদু স্বরে বলো। এমনকি যদি তোমার বিশ্বাস দুর্বল হয়, তবুও নিজেকে বলো। একে বিশ্বাস করতে করতে বলো, হতাশ মানুষদের বলো, যাদের ভালোবাসা কম, তাদের বলো: সেরা মদ এখনো পরিবেশিত হয়নি।
যতক্ষণ আমরা একটি শিশুর দৃষ্টিতে আনন্দ খুঁজে পাই এবং মনের গভীরে থাকা অসীম স্নেহ-সজ্জায় নিজেকে ভরিয়ে রাখতে পারি, যতক্ষণ আমরা আমাদের মধ্যে করুণা ধারণ করি, ততক্ষণ সবকিছুই সম্ভব। আশা নামক নোঙরটি আঁকড়ে ধরে আমরা কবি নজিম হিকমতের লাইনগুলো বলতেই পারি:
সবচেয়ে সুন্দর সাগরআমরা এখনো পার হয়নি।সবচেয়ে সুন্দর শিশুএখনো বড় হয়নি।আমাদের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলোআমরা এখনো দেখিনি।আর তোমাকে বলার জন্য আমার সবচেয়ে সুন্দর কথাআমি এখনো বলিনি...
আত্মার হাওয়া এখনো বইছে। আমার ভাই ও বোনেরা তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।