দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো অ্যালেকজান্ডার ডুমার রচিত ১২৫০ পৃষ্ঠার রোমাঞ্চকর উপন্যাস, যা তিনি সহলেখকের সহযোগিতায় রচনা করেছিলেন। ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে একটি ফরাসি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো
রিটন খান
"ঘৃণা, অন্ধ ক্রোধ মানুষকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যায়, এবং প্রতিশোধের পথ ধরে যে চলে, তাকে তিক্ততার স্বাদ নিতে হতে পারে।"
এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করেছিঃ
উপন্যাস ভাবনা
কিছু উল্লেখযোগ্য সিক্যুয়েল
অনুবাদ প্রসঙ্গ
অ্যালেকজান্ডার ডুমা
প্রসঙ্গিক কিছু বই
আরও কিছু একই জরনার বই
উপন্যাসটি থেকে আমার কিছু প্রিয় উক্তি
অ্যালেকজান্ডার ডুমা'র জীবনের ক্রমানুসার
চরিত্রের তালিকা
শৈশবে সেবা প্রকাশনীর প্রকাশিত কাজী শাহনূর হোসেনের ভাবানুবাদে দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো পড়েছিলাম। এটি মূল উপন্যাসের সম্পূর্ণ সংস্করণ ছিল না, বরং সংক্ষিপ্ত একটি সংস্করণ। তবু সেই কাহিনির প্রতিটি পৃষ্ঠা আমাকে শিহরণে ভরিয়ে দিয়েছিল। রোমাঞ্চ আর রহস্যে মোড়া গল্পের জগতে ডুব দিয়ে আমি যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছিলাম। যা একজন কিশোর পাঠকের কল্পনা জগৎকে অতিক্রম করে তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। মূল কাহিনি পড়ার ইচ্ছা তখনই জেগেছিল, তারপর অনেক বছর কেটে যায়। The Count of Monte Cristo (Penguin Classics) বইটি হাতে পাওয়ার পরে গোগ্রাসে পড়েছিলাম। এত অসংখ্যবার পড়েছি যে অনেক উদ্ধৃতি মুখস্ত হয়ে গেছে। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন "অ্যালেকজান্ডার ডুমার নাম শুধু ফরাসি নয়, এটি ইউরোপীয়; এটি শুধু ইউরোপীয় নয়, এটি বিশ্বজনীন।" অ্যালেকজান্ডার ডুমা নিঃসন্দেহে ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। এই দেশ থেকে ভিক্টর হুগো, অনোরে দ্য বালজাক, জুল ভার্ন এবং এমিল জোলার মতো আরও বহু বিখ্যাত লেখক উঠে এসেছেন, যাদের মতো ডুমাও উনিশ শতক থেকে আজও বিপুল পাঠকপ্রিয়। আজ এই লেখায় আমি উপন্যাসের আলোচনা করতে আসিনি, এটা আমার অ্যালেকজান্ডার ডুমার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, যিনি কোন এক রাতে এক কিশোরকে রোমাঞ্চ আর রহস্যে মোড়া গল্পের জগতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো প্রথমে ধারাবাহিক আকারে Journal des Débats-এ প্রকাশিত হয় ১৮৪৪ সালের আগস্টে এবং এটি ১৮৪৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সময়ে প্রথম ১৮-খণ্ডের সংস্করণটি পেটিয়ঁ প্রকাশনী থেকে ১৮৪৫-৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৮৪৬ সালেই দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, পাশাপাশি ১৮৪০-এর দশকে কয়েকটি পাইরেট সংস্করণও বাজারে আসে। উনিশ শতকজুড়ে বইটি পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। ডুমার জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণটি ১৮৬৫ সালে মিশেল লেভি প্রকাশনী থেকে বের হয়।
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো অ্যালেকজান্ডার ডুমার রচিত ১২৫০ পৃষ্ঠার রোমাঞ্চকর উপন্যাস, যা তিনি সহলেখকের সহযোগিতায় রচনা করেছিলেন। এই উপন্যাসটি ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে একটি ফরাসি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। আমি রবিন বাসের অনুবাদে পেঙ্গুইন ক্লাসিক্স সংস্করণটি পড়েছি।
এক জীবনে কতই বা বই পড়া যায়, তাই সেরা বা সবচেয়ে আনন্দদায়ক বইগুলোই আগে পড়া উচিত। দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো এমনই একটি চমৎকার বই—প্রতিশোধের শ্রেষ্ঠ গল্প। এটি এমন এক কাহিনি, যা লটারি জেতার স্বপ্ন দেখা যেকোনো ব্যক্তির কল্পনাকে পরিপূর্ণ করতে পারে। একইসঙ্গে এটি চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির বিজয়ের গল্প, যা চিরকালীন মানবিক থিমের প্রতিচ্ছবি।
ধরুন, আপনার বয়স উনিশ বছর, আপনি সুদর্শন, বুদ্ধিমান, এবং আপনার স্বপ্নের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে। আপনার বস আপনাকে নিজের জাহাজের অধিনায়ক বানিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের দিনেই আপনার জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। আপনি এমন একটি রাজনৈতিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, যার সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, বিচার বা দণ্ড ছাড়াই, আপনি পরবর্তী চৌদ্দ বছর একটি দুর্গম দ্বীপের কারাগারের এক কক্ষে বন্দী থাকেন। এই সময় আপনাকে বাঁচিয়ে রাখে কেবল পাশের সেলের আরেক কারাবন্দির বন্ধুত্ব এবং প্রতিশোধের এক অদম্য ইচ্ছা—যারা আপনার জীবন ধ্বংস করে আপনাকে সেই ঘৃণ্য জায়গায় নিক্ষেপ করেছিল।
"বাঁচার আনন্দ বুঝতে হলে মৃত্যুর ইচ্ছা কখনো না কখনো অনুভব করতেই হয়।"
আপনার হতাশার যখন চরমে তখন আপনি পালানোর সুযোগ পান। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনি এমন এক অমূল্য ধনসম্পদের মালিক হন, যার তুলনা পৃথিবীতে বিরল। আপনার বয়স তেত্রিশ। ততদিনে আপনার পরিবারের সকলে দারিদ্র্যের কষাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে, আর শৈশবের প্রেমিকা বিয়ে করেছেন আপনারই বন্ধুরুপী শত্রুকে। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে। যাঁরা আপনাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল, তাঁরা এখন ফরাসি সমাজের শীর্ষস্থানে। অথচ আপনি এখন সম্পদের চূড়ান্ত শিখরে। এরপর কী করবেন? প্রতিশোধ—নিঃসন্দেহে। তবে সাধারণ প্রতিশোধ নয়, বরং সুচারুভাবে পরিকল্পিত, অমোঘ প্রতিশোধ।
"তুমি জানো না, সেই চৌদ্দ বছরের প্রতিটি দিন আমি নতুন করে প্রতিশোধের শপথ নিয়েছিলাম।"
এরপর সবকিছু দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে—প্রভু যেন আপনাকে তার করুণার আলোয় ভরিয়ে দিয়েছেন। আপনি কি ঈশ্বরের দূত? এরপর শুরু হয় এক দুঃসাহসিক রোমাঞ্চ ও রোমাঞ্চকর নাটক, যা ১৮৪০-এর দশকের বিলাসিতাকে জীবন্ত করে তোলে। দৃষ্টিনন্দন সাজে ভরা আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি, জমকালো ডিনার ও নৃত্যনৈপুণ্যের আসর, ফ্যাশন আর অপেরা, হাশিশ আর এক রহস্যময় নারী বিষপ্রয়োগকারীর চমকপ্রদ গল্প—সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
ডাকাত আর চোরাচালানকারী। বন্দুকযুদ্ধ। প্রেম আর রোমাঞ্চ। দুটি শিশুহত্যা, তিনটি আত্মহত্যা। সম্মান আর ষড়যন্ত্র। প্রতারণা আর জীবন্ত কবর। রাজনৈতিক চক্রান্ত আর দুর্নীতি। মাদকসেবন যৌন কল্পনার প্রদর্শনী। হারিয়ে যাওয়া জাহাজ আর সমকামী নারীদের পালায়ন। কারাগার ভাঙা আর মৃতের পুনর্জাগরণ। শেয়ারবাজার কারসাজি আর ব্যাংক ধ্বংস। রহস্যময় গল্প—ভ্যাম্পায়ার, ভূত আর বাগানে লাশের কথোপকথন। আপনি একটি মজাদার রোমাঞ্চকর বইতে যে সব আশা করেন, তার সবই এখানে পাবেন।
এই উপন্যাসকে উনিশ শতকের গেম অফ থ্রোনস (টিভি সিরিজ)-এর সমতুল্য বলা যেতে পারে, তবে এটি আরও কেন্দ্রীভূত এবং এর সমাপ্তি আরও সন্তোষজনক।
গেম অফ থ্রোনস রচয়িতা জর্জ আর. আর. মার্টিন এমন সব বিষয় যোগ করেন যা গল্পের অগ্রগতিতে সহায়ক নয়, বরং কেবল স্থান পূরণ করে। তার মতে, "গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই মূল বিষয় নয়; পাঠককে একটি জগতে নিমগ্ন করাই আসল।" কিন্তু দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো দেখায় যে গল্প এগিয়ে নেওয়া এবং পাঠককে এক নতুন জগতে নিমজ্জিত করা, উভয়ই একসঙ্গে করা সম্ভব। বিশাল চরিত্রসমষ্টি, জটিল মোড় ও উপকাহিনি সত্ত্বেও, সবকিছু শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে মিলে যায়। এখানে পাঠকদের আমি একটি পরামর্শ দিতে চাই, বিশ্বাস রাখুন, ধৈর্য ধরে পড়ুন। এখানে কোনো কাহিনি অপ্রাসঙ্গিক নয়। যা করতে হবে তা হলো—‘অপেক্ষা’ । ডুমা প্রতি লাইনের জন্য পারিশ্রমিক পেতেন এবং কাহিনি মাসের পর মাস ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটি বিশৃঙ্খল নয়, বরং একটি দীর্ঘ, সুচারুভাবে পরিকল্পিত বিস্ফোরণের মতো।
আমি কখনোই এমন কোনো উনিশ শতকের বড় উপন্যাস পড়িনি, যেখানে দাস এবং দাসত্ব নিয়ে দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-র মতো স্বাধীনভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিছু পাঠকের জন্য এটি অস্বস্তিকর হতে পারে। এই উপন্যাসে দুজন চরিত্র রয়েছে, যারা দাস ছিল এবং কাউন্ট তাদের কিনে মুক্তি প্রদান করেন, এর মাধ্যমে তারা তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়।
"আমার চারপাশে যারা আছে, তারা যেকোনো সময় আমাকে ছেড়ে যেতে পারে, এবং যখন তারা আমাকে ছেড়ে যাবে, তখন তাদের আর আমার বা অন্য কারও প্রয়োজন থাকবে না। হয়তো এই কারণেই তারা আমাকে ছেড়ে যায় না।"
কাউন্টের শঁজ এলিজের বাড়িতে থাকেন দুই মুক্তিপ্রাপ্ত দাস—প্রথমজন আলি, এক বিশ্বস্ত চাকর যিনি মূক, তাই নিজের পক্ষে কিছু বলতে পারেন না। যদিও দক্ষ, তার চরিত্রটি প্রায় স্টেরিওটাইপিক্যাল এবং বেশিরভাগ সময় প্যাসিভ। দ্বিতীয়জন হায়দে, এক ‘গ্রীক’ মেয়ে (আসলে তিনি আলবেনীয়)। তিনিও বেশিরভাগ সময় প্যাসিভ চরিত্র, এবং কাউন্টের প্রতি তার গভীর প্রেম উপন্যাস জুড়ে স্পষ্ট। তার জীবনকাহিনি আকর্ষণীয় এবং চরিত্রে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও, ডুমা সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেননি।
উপন্যাসের শেষাংশ কিছুটা তাড়াহুড়ো করে লেখা মনে হয়। ডুমার সঙ্গে আমরা ১২৫০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ যাত্রা করেছি, আরও ৫০ পৃষ্ঠা থাকলে কাউন্ট ও হায়দের সম্পর্কের গভীরতা সুন্দরভাবে প্রকাশ পেত। যদিও তাদের মধ্যে কয়েকটি হৃদয়বিদারক মুহূর্ত ছিল, ডুমা তাদের রোমান্টিক সম্পর্ককে যথেষ্ট সময় দেননি, ফলে শেষ দৃশ্যের পালতোলা নৌকায় তাদের একসঙ্গে যাত্রা কিছুটা পরবর্তী চিন্তার মতো মনে হয়। তবে, শেষ পর্যন্ত, হায়দের ভালোবাসাই কাউন্টকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে।
এডমন্ড দান্তেস কাহিনির শুরুতে একজন সরল-সাধারণ শিক্ষিত তরুণ নাবিক। জীবনে চরম অন্যায় ও দুঃখ-কষ্ট সয়ে তিনি এক নতুন রূপে আবির্ভূত হন—মন্টে ক্রিস্টোর কাউন্ট। প্রতিশোধ তার একমাত্র লক্ষ্য, আর এই লক্ষ্য পূরণে তার রয়েছে প্রায় অতিমানবীয় ক্ষমতা। দান্তেস কাহিনির শুরুতে যেন ব্রুস ব্যানার, আর শেষ পর্যন্ত তিনি রূপান্তরিত হন দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক-এ।
"আমার সাম্রাজ্যের সীমানা পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত, কারণ আমি ইতালীয়, ফরাসি, হিন্দু, আমেরিকান বা স্প্যানিশ নই—আমি একজন বিশ্বনাগরিক। কোনো দেশ বলতে পারে না, সে আমার জন্ম দেখেছে। ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না, কোন দেশ আমার মৃত্যু দেখবে। আমি সব রীতিনীতি গ্রহণ করি, সব ভাষায় কথা বলি... ক্ষমতাশালীদের যে দ্বিধা থামিয়ে দেয়, বা দুর্বলদের যে বাধা অবশ করে, তা আমাকে থামাতে পারে না।"
"সে কি মানুষ, নাকি দানব—নাকি উভয়ই?"
আশ্চর্যের বিষয়, দ্য হাল্ক-এর স্রষ্টা স্ট্যান লি স্বীকার করেছেন যে তার এই চরিত্রের প্রেরণা এসেছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন (১৮১৮) এবং স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড (১৮৮৬) থেকে। হাল্কের মতোই, মন্টে ক্রিস্টোর কাউন্ট তার ক্রোধে চূড়ান্ত ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠেন। প্রতিশোধের অগ্নিগর্ভ আকাঙ্ক্ষা দান্তেসকে বন্দিত্ব সহ্য করার শক্তি দেয়, পালানোর ইচ্ছাশক্তি জোগায় এবং মুক্তির পর তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। তবে, এর ফলে তরুণ এডমন্ড দান্তেস যেন ধীরে ধীরে নিজেই মরে যায়, তার জায়গায় আবির্ভূত হয় প্রতিশোধপ্রবণ কাউন্ট।
"আমি কীভাবে পালিয়েছিলাম? কঠিন পরিশ্রমে। আমি এই মুহূর্তের পরিকল্পনা কীভাবে করেছিলাম? পরম আনন্দে।"
হারিয়ে যাওয়া সারল্য আর কখনো ফেরানো যায় না। আর আমাদের অভ্যাস, ভালো হোক বা খারাপ, ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়। উপন্যাসের কাহিনিতে কাউন্ট এক ধরনের বিজয় অর্জন করেন, তবে এর জন্য তাকে জীবনের সকল অর্থপূর্ণ জিনিস হারাতে হয়েছে। শেষের দিকে তিনি উপলব্ধি করেন, তার প্রতিশোধ অনেকের জীবনকে ধ্বংস করেছে—তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। নতুন জীবন শুরু করার সম্ভাবনা তার জন্য উন্মুক্ত, তবে তা সম্ভব কেবল তখনই, যখন তিনি প্রতিশোধ ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দেবেন এবং ভালোবাসার অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হবেন।
"ঈশ্বর আমাকে আমার শত্রুদের সঙ্গে সংগ্রামে সহায়তা করেছেন এবং এই পুরস্কার দিয়েছেন; তিনি আমার বিজয়কে দুঃখে শেষ হতে দেবেন না। আমি নিজেকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে ক্ষমা করেছেন। তবে আমাকে ভালোবাসো, হায়দে! ... তোমার একটি কথা আমাকে বিশ বছরের অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি আলোকিত করেছে। আমার জীবনে কেবল তুমিই আছো, হায়দে; তোমার মাধ্যমেই আমি আবার জীবনের আশা ধরেছি।"
ডুমার লেখার শৈলী চারটি রঙে রচিত: কালো এবং সাদা, লাল (রক্ত), আর বেগুনি (অলঙ্কৃত ভাষা)। এটি সরল, চিত্রময় এবং সহজবোধ্য। কাহিনি এমন এক দুর্দান্ত দুঃসাহসিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠককে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বা মুগ্ধ হয়ে পড়ার আহ্বান জানায়। এখানে ভাষার সূক্ষ্মতা বা নির্ভুলতার প্রতি মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে গল্প বলার গতিময়তায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইতালীয় লেখক এবং অধ্যাপক উমবের্তো ইকো দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-এর এভরিম্যান এডিশন-এর একটি চমকপ্রদ ভূমিকায় (যা দ্য প্যারিস রিভিউ-এর একটি প্রবন্ধেও ছাপা হয়েছে) বলেছেন:
"দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো অবশ্যই সর্বকালের অন্যতম মনোমুগ্ধকর উপন্যাস, কিন্তু একই সঙ্গে এটি সব সাহিত্যিক ধারার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলভাবে লেখা উপন্যাসগুলোর একটি।"
উমবের্তো একো উল্লেখ করেছেন যে তিনি দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-এর একটি সংস্করণ অনুবাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিন্তু বই ও লেখকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও ১০০ পৃষ্ঠার পর সেই কাজ ছেড়ে দেন।
তিনি বলেন:
"বইটিতে অসংখ্য ফাঁকফোকর রয়েছে... একই বিশেষণ বারবার একাধিক লাইনে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এটি নির্লজ্জ... অনুভূতির চিত্রণে এটি যান্ত্রিক ও অপটু: চরিত্ররা হয় কাঁপে, নয় ফ্যাকাসে হয়ে যায়, নয়তো তাদের কপাল থেকে বড় বড় ঘামের ফোঁটা মুছতে থাকে...।"
আধুনিক অনুবাদ পড়েও একোর এই মন্তব্যের সত্যতা পুরোপুরি এড়ানো কঠিন। তবে ১৮০০ সালের একটি অনুবাদ খুললেই আপনি একোর বর্ণনার পুরো চিত্র খুঁজে পাবেন—ঠিক যেমন তিনি বলেছেন। আর আশ্চর্যের বিষয়, ভিক্টোরিয়ান যুগেই উপন্যাসটি তার খ্যাতি অর্জন করে।
সে সময়ের পাঠকরা ভাষার এই আড়ম্বরপূর্ণ শৈলীতে আনন্দ পেতেন, এবং সেই নাটকীয়, সংবেদনশীল উপস্থাপনাই উপন্যাসটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। ভাষাগত দিক থেকে সীমাবদ্ধ হলেও, এর কাহিনির শক্তি এবং রোমাঞ্চই একে কালজয়ী করে তুলেছে।
"কিন্তু তুমি কী করছিলে? তুমি কিছু লিখছিলে।""আমি?""তোমার আঙুলে কালি লেগে আছে।""আহ, ঠিকই, আমি লিখছিলাম। মাঝে মাঝে লিখি, যদিও আমি একজন সৈনিক।"
মন্টে ক্রিস্টো ঘরের ভেতরে এগিয়ে গেলেন; ম্যাক্সিমিলিয়ান বাধ্য হয়ে তাকে যেতে দিলেন, তবে পিছু নিলেন।"তুমি লিখছিলে?" মন্টে ক্রিস্টো গভীর নজরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।"আমি তো আপনাকে ইতোমধ্যেই বলেছি যে লিখছিলাম," মরেল উত্তর দিলেন।
উমবের্তো একো মনে করেছিলেন যে, উপন্যাসটির সারমর্ম অপরিবর্তিত রেখে তিনি এর ২৫% লেখা সহজেই বাদ দিতে পারতেন। তবে তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন, কারণ পাঠকেরা উপন্যাসের লেখার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অদ্ভুততা ও দুর্বলতাগুলো গ্রহণ করেছিলেন এবং ভালোবেসেছিলেন। এগুলোই বইটিকে আইকনিক করে তুলেছিল এবং তার চারপাশে এক বিশেষ মিথ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
একোর বক্তব্যকে উপলব্ধি করতে হলে কল্পনা করুন, যদি বিভিন্ন কালজয়ী চলচ্চিত্র থেকে তাদের এক-চতুর্থাংশ অংশ সম্পাদনা করে সরিয়ে ফেলা হতো—পথের পাঁচালি, পাল্প ফিকশন, দ্য উইকার ম্যান, কাসাব্লাঙ্কা, ২০০১: এ স্পেস ওডিসি, ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ এর মতো যেকোনো ছবি। ফলাফল হতো একেবারেই বাজে। এদের শৈলীর বিস্তার এবং গল্প বলার অনন্যতা ছাঁটাই করলে সেগুলো তাদের মূল আকর্ষণ হারিয়ে ফেলত। ঠিক তেমনই, ডুমার এই উপন্যাসের অসম্পূর্ণতা এবং অতিমাত্রায় নাটকীয়তাই একে বিশেষত্ব দিয়েছে।
একো মনে করতেন, উপন্যাসের ভাষাকে দীর্ঘায়িত করা পাঠকের আনন্দ ও যন্ত্রণা উভয়কেই বাড়িয়ে তোলে। প্রতীক্ষার মাধুর্য বা তীব্রতা অনুভূতিকে দ্বিগুণ করে।
"ডুমার উপন্যাস একধরনের মেশিন, যা যন্ত্রণার সময়কাল বাড়িয়ে তোলে। এখানে মৃত্যুযন্ত্রণা কতটা গভীর তা নয়, বরং তা কতটা দীর্ঘস্থায়ী—সেইটাই গুরুত্বপূর্ণ।"
ডুমার লেখার এই ধীরগতি উপন্যাসের নাটকীয়তা ও সংবেদনশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কাহিনির মোড় কিংবা প্রতিশোধের ক্লাইম্যাক্স যত বিলম্বিত হয়, ততই পাঠক আনন্দে মগ্ন হন বা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠেন। একোর মতে, এই টানাপোড়েনের নির্মাণই উপন্যাসটির বিশেষত্ব। দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-র দীর্ঘায়িত গদ্য তাই কেবল একটি শৈলগত বৈশিষ্ট্য নয়, এটি উপন্যাসের আবেগঘন শক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইশ, যদি ডুমা দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-এর একটি সিক্যুয়েল লিখতেন! যদিও অনেক চরিত্র মারা গেছে, কারাগারে বা উন্মাদ আশ্রমে, তবু সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রগুলো এখনও বেঁচে আছে। এবং তারা আগের চেয়ে আরও প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে ।
আমি নিশ্চিত নই যে ব্যারন ড্যাংলার্সের গল্প এখানেই শেষ । আর জেরার দ্য ভিলফোরের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থাও সেরে উঠতে পারে, বিশেষত যখন সে বুঝতে পারবে তার একটি সন্তান এখনও জীবিত আছে—তার চতুর এবং অবৈধ সন্তান বেনেদেত্তো।
এই সিক্যুয়েলে এই বাবা-ছেলে জুটি শয়তানি বুদ্ধি নিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে এবং তাদের কাহিনি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে বাধ্য। সম্ভবত, প্রথম উপন্যাসের "Dark Powers" দ্বিতীয় উপন্যাসে একত্রিত হয়ে কাউন্টের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে, কারণ তারা কাউন্টের প্রকৃত পরিচয় জানে।
দুঃখজনকভাবে, এটি কেবল আমাদের কল্পনা। ডুমা নিজে কখনো সিক্যুয়েল লিখেননি, যদিও অন্য লেখকদের লেখা আটটি সিক্যুয়েল আছে। তবে, ডুমার মতো সিক্যুয়েল যে অন্য কেউ লিখতে পারবে না, তা নিশ্চিত।
কিছু উল্লেখযোগ্য সিক্যুয়েল:
১৮৫৬: The Lord of the World (অ্যাডলফ মুটজেলবার্গ), জার্মান ভাষায় প্রকাশিত।
১৮৮১: The Son of Monte Cristo (জুলস লারমিনা), যা ইংরেজি অনুবাদে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল: The Wife of Monte Cristo এবং The Son of Monte Cristo। নিউ ইয়র্কে ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত, জ্যাকব রাল্ফ অ্যাবারবানেলের অনুবাদে।
১৮৮৪: Edmond Dantès: The Sequel to Alexander Dumas' Celebrated Novel The Count of Monte Cristo (এডমন্ড ফ্ল্যাগ), ইংরেজিতে ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত।
১৮৮৪: Monte-Cristo's Daughter: Sequel to Alexander Dumas' Great Novel (এডমন্ড ফ্ল্যাগ), এটি Edmond Dantès-এর পরবর্তী কাহিনি।
১৮৮৫: The Treasure of Monte-Cristo (জুলস লারমিনা)।
১৮৬৯: The Countess of Monte Cristo (জাঁ চার্লস দু বোয়া), ইংরেজি সংস্করণে ১৮৭১ সালে প্রকাশিত।
১৮৮৭: Monte Cristo and His Wife, সম্ভবত জ্যাকব রাল্ফ অ্যাবারবানেলের লেখা।
১৯০২: Countess of Monte Cristo (জ্যাকব রাল্ফ অ্যাবারবানেল)।
এই সিক্যুয়েলগুলো মূল উপন্যাসের জাদু ধরে রাখতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এগুলো দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-এর মিথকে আরও বিস্তৃত করেছে। পাঠকদের মধ্যে এখনও সেই কাহিনির রেশ ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট।
… এবং এভাবেই কাহিনির সমাপ্তি! 🌟
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো অনুবাদ প্রসঙ্গে
উপন্যাসটি দ্রুত ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ১৮৪৫ সালে ইংল্যান্ডের Ainsworth’s Magazine-এ এবং ১৮৪৬ সালে এমা হার্ডি দ্বারা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। একই বছরে এটি আমেরিকাতেও অনূদিত হয়। এছাড়াও, এটি ডেনিশ (১৮৪৫-৪৬), সুইডিশ (১৮৪৬), ইতালীয় (ওরেস্তে ফেরারিও, ১৮৪৭), স্প্যানিশ (১৮৫৮), নরওয়েজিয়ান (১৮৮১-৮২), এবং জার্মান (১৯০২) ভাষায় অনূদিত হয়।
উপন্যাসটির প্রথম মঞ্চরূপ ডুমা এবং মাকেট নিজেরাই তৈরি করেন—১৮৪৮ সালে দুই ভাগে, ১৮৫১ সালে পুনরায় দুই ভাগে, এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৬২ সালে পাঁচ অঙ্ক ও ১২ ট্যাবলোতে একটি একক পরিবেশনা হিসেবে মঞ্চস্থ হয়।
এর অনেক আগেই, ১৮৪৭ সালে ডেফরজেস এবং ক্লেয়ারভিল উপন্যাসটির Le Comte de Monte-Fiasco নামে একটি মঞ্চ-প্যারোডি তৈরি করেন, যা উপন্যাসটির জনপ্রিয়তার আরেকটি উদাহরণ।
সাম্প্রতিক মঞ্চরূপটি ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডে মঞ্চস্থ হয়। এছাড়া, উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, শিশুতোষ সংস্করণ এবং কমিক বইয়ের সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে।
উপন্যাসটির উপর ভিত্তি করে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে: ১৯০৮ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ১৯১৩ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ১৯১৪ (ফ্রান্স), ১৯৩৪ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ১৯৪২ (ফ্রান্স), ১৯৫৩ (ফ্রান্স), ১৯৬১ (ফ্রান্স), ১৯৭৫ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ২০০১ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ২০২৪ (ফ্রান্স))। এছাড়া টেলিভিশন সংস্করণও নির্মিত হয়েছে। পৃথিবীর নানান দেশের অনেক চলচ্চিত্র এই গল্পের অনুকরণে তৈরি, যা উপন্যাসটির জনপ্রিয়তার আরেকটি উদাহরণ।
গল্পটির শক্তিশালী মূল থিম—বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যায় কারাদণ্ড এবং প্রতিশোধ—এর জন্যই উপন্যাসটি এত সহজে বিভিন্ন মাধ্যমে রূপান্তরযোগ্য হয়েছে। এর দীর্ঘতার কারণে অনেক উপ-প্লট বাদ দেওয়া হলেও মূল থিমটি পাঠক এবং দর্শকদের কাছে স্পষ্ট ও আকর্ষণীয় রয়ে গেছে।
উপন্যাসটি এতটাই বিশাল যে পুরোপুরি উপস্থাপন করা সবসময় সম্ভব হয় না। প্রথম থেকেই দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, যেন এর বিশালতাকে সামলানো যায়। পাশাপাশি, দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো যে ঐতিহাসিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিও এর তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যিক উপন্যাসের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সমাজ বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর বিপরীতে, অতিরঞ্জিত চরিত্র ও নাটকীয় ঘটনাগুলোকে কেবল বিনোদন হিসেবে দেখা হত। ডুমার উপন্যাসগুলো বিনোদনমূলক হলেও বাস্তবধর্মিতার প্রবণতা তার সাহিত্যিক ভাবমূর্তির জন্য খুব সহায়ক ছিল না। তার লেখা ছিল আনন্দময়, যা বিনোদনের জন্য তৈরি ও প্রচুর বিক্রি হত।
এ কারণেই, যদিও থ্যাকারি স্বীকার করেছিলেন যে দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো পড়া থামানো অসম্ভব, ইংরেজ উপন্যাসিক জর্জ এলিয়ট মনে করতেন যে ডুমা, হুগো এবং বালজাকের মতো ফরাসি লেখকেরা ভুলভাবে ব্যতিক্রমী চরিত্র ও ঘটনায় বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তাদের উচিত ছিল মানব প্রকৃতির গভীরতা বোঝার জন্য দৈনন্দিন জীবনের বিশ্লেষণ করা। তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে Middlemarch এবং The Mill on the Floss-এর লেখিকা The Three Musketeers বা The Count of Monte Cristo-এ খুব একটা আনন্দ খুঁজে পাননি।
ডুমার শৈলী সাধারণ, এবং তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলো মাকেটের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা। তাই দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো প্রায়শই ক্লাসিক্যাল গ্রন্থের চেয়ে বিনোদনমূলক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর রূপান্তর ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণগুলো ভাবানুবাদ হলেও প্রায়শই বেশি সফল হয়েছে। উনিশ শতকের অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের মতোই এটি তরুণদের সাহিত্য বা বিনোদন হিসেবে দেখা হয়েছে।
উপন্যাসটির বিষয়বস্তুর কারণে এটি তরুণ পাঠকদের বা মধ্য-ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের পাঠকদের উপযোগী করতে পরিবর্তন করতে হয়েছে। এবং যেহেতু এটি একটি ‘জনপ্রিয়’ উপন্যাস এবং অনুবাদের জন্য বিরাট পরিশ্রমের দাবি রাখে, তাই ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় এটি পুনরায় অনুবাদের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।
ক্লদ শপের ১৯৯৩ সালের সংস্করণ (রবার্ট লাফঁ) প্রধান বিদেশি অনুবাদগুলোর তালিকা দেয়, যেখানে ১৯১০ সালের পর ইংরেজিতে কোনো নতুন অনুবাদের উল্লেখ নেই। বর্তমানে ব্রিটেনে সহজলভ্য সংস্করণটি ১৮৪৬ সালে চ্যাপম্যান অ্যান্ড হল থেকে প্রকাশিত বেনামী অনুবাদের পুনর্মুদ্রণ। অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড’স ক্লাসিকস সিরিজের (১৯৯০) সম্পাদক ডেভিড কাউয়ার্ড উল্লেখ করেছেন যে, “দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পরবর্তী অনুবাদগুলো মূলত এই ক্লাসিক সংস্করণের উপরই নির্ভরশীল।”
যারা শুধুমাত্র এই ‘ক্লাসিক সংস্করণে’ দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো পড়েছেন, তারা আসলে ডুমার মূল উপন্যাস কখনোই পড়েননি। প্রথমত, অনুবাদটি মাঝে মাঝে ভুল এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজিতে লেখা, যা আজকের পাঠকদের কাছে মূল ফরাসি ভাষার তুলনায় আরও পুরনো মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ডুমার কথোপকথনের ধারা ইংরেজি অনুবাদে “said he” বা “cried he”-এর মতো অতিরিক্ত উল্টোপাল্টা শব্দগঠনে বিরক্তিকর ও পুরনো শোনায়।
এর সঙ্গে আছে কিছু অদ্ভুত সংযোজন, যেমন চ্যাপ্টার ২৫-এ এক নাবিকের কথোপকথন: “that’s one of them nabob gentlemen from Ingy [sic], no doubt…,” যা ডুমার মূল রচনার সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। উপরন্তু, ঊনবিংশ শতাব্দীর এই অনুবাদের অধিকাংশ সংলাপ, যেমন “I will join you ere long,” “I confess he asked me none,” এবং “When will all this cease?” — এগুলো ভিক্টোরিয়ান যুগের থিয়েটারের গ্যাসলিট মেলোড্রামার সুরই প্রকাশ করে।
ভিক্টোরিয়ান অনুবাদে ডুমার ভাষার একটি দিক প্রকাশ পেলেও মূল টেক্সটের ব্যাপক কাটছাঁট ও পরিবর্তন তাৎপর্য নষ্ট করেছে। চ্যাপ্টার ৩১-এ ফ্রাঁজের আফিম স্বপ্ন, চ্যাপ্টার ৬৭-এ ভিলফোর ও ম্যাডাম ড্যাংলার্সের সংলাপ, এবং চ্যাপ্টার ৯৭-এ ইউজেনি ও লুইসের পালিয়ে যাওয়ার অংশ অনুবাদে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনুবাদে অনেক সংলাপের অর্থও পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ইউজেনি সম্পর্কে ডুমার মন্তব্য "তিনি যেন অন্য লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত" অনুবাদে "তার শিক্ষায় পুরুষালী বৈশিষ্ট্য" বলা হয়েছে। "অপহরণ" শব্দটি বদলে "পালিয়ে যাওয়া" করা হয়েছে, যা মূল অর্থ বিকৃত করেছে। এই পরিবর্তনগুলো ডুমার রচনার আসল ভাব এবং শক্তি অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।
অভিজাত ভিক্টোরিয়ান যুগের রুচির প্রতি কিছুটা আপস করলেও, অনুবাদকারীরা মূল টেক্সট থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়েছেন, যা বিস্ময়কর। তবে বাদ দেওয়া অংশগুলো শুধু যৌন প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। চ্যাপ্টার ৩৪-এ রোমে আলবে ও ফ্রাঁজের পথচলার বিবরণ বাদ দেওয়া হয়েছে (১৮৯৪ সালের অনুবাদে এটি পুনরুদ্ধার করা হয়)। চ্যাপ্টার ৪৮-এ এম. দে ভিলফোরের চরিত্র বিশ্লেষণের একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ এবং চ্যাপ্টার ৮৫-এ আলবে ও মন্টে ক্রিস্টোর মধ্যে ঘোড়া নিয়ে কথোপকথনের প্রায় একটি পৃষ্ঠা বাদ পড়েছে (১৮৯৪ সালের অনুবাদে কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়)। এটি মাত্র কয়েকটি উদাহরণ; প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য বাক্য বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কখনো কখনো ভুল অনুবাদ করা হয়েছে।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ডুমার মূল টেক্সটকে সরল, জটিলতা মুক্ত এবং রূপকের কম ব্যবহার, কাহিনি-নির্ভর ও অ্যাকশনভিত্তিক করা হয়েছে। ১৮৪৬ সালের অনুবাদক মনে করেছিলেন, এই উপন্যাস একটি থ্রিলার এবং যা প্লটের জন্য অনেক কিছু অপ্রয়োজনীয়—যেমন ভ্রমণ বিবরণ, শাস্ত্রীয় রেফারেন্স, যৌন ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—যা বাদ দেওয়া উচিত। তৎকালীন ইংরেজ পাঠকদের বিব্রত করতে পারে এমন অংশগুলিও ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পেঙ্গুইন সংস্করণে অনুবাদক রবিন বাস, অনুবাদের ভিত্তি হিসেবে ক্লদ শপের উল্লেখিত সংস্করণ এবং Livre de Poche-এর তিন খণ্ডের ১৯৭৩ সালের সংস্করণ ব্যবহার করেছেন। এই সংস্করণগুলোর অধ্যায় বিন্যাস ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি অনুবাদ থেকে কিছুটা আলাদা। তিনি Livre de Poche-এর ধারা অনুসরণ করে ডুমার মূল টেক্সটের সময়ানুক্রমিক ‘ভুলগুলো’ পরিবর্তন করেননি, যা শপ করেছেন। বরং, তিনি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিগুলো টীকায় উল্লেখ করেছেন।
তিনি সর্বোপরি একটি সঠিক এবং পাঠযোগ্য সংস্করণ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। অনুবাদ নিয়ে বিশেষত একাডেমিক মহলে অনেক তাত্ত্বিক বিতর্ক রয়েছে। লিওনার্ড টানকক লিখেছিলেন, “অনুবাদককে সর্বদা মূল টেক্সটের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে, অনুবাদকের কোনো অধিকার নেই মূল টেক্সটের উপর ছাড় দেওয়ার, ‘নীরস’ অংশ বাদ দেওয়ার, অতিরিক্ত ব্যাখ্যা যোগ করার বা অধ্যায় বিন্যাস পরিবর্তনের।” পাঠক কি সত্যিই এমন নিখুঁত, নির্ভুল এবং ব্যাখ্যাহীন অনুবাদ চান? একাডেমিক তাত্ত্বিকদের জোর দাবি যে একটি অনুবাদকে অনুবাদের মতোই পড়া উচিত—অনুবাদ প্রক্রিয়াকে আড়াল করা নাকি অনৈতিক। কিন্তু আমরা সাধারণ পাঠকরা প্রায়শই ঠিক এর উল্টোটাই চাই।
অ্যালেকজান্ডার ডুমা
"সমস্ত জ্ঞান এই দুটি শব্দে নিহিত—অপেক্ষা করো এবং আশা রাখো।" - দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো
পন্থিয়ন—ফ্রান্সের সেই সাহিত্যিক মর্যাদাপূর্ণ স্থান, যেখানে জাতির মহান পুরুষরা(এবং মাঝে মাঝে নারী) চিরনিদ্রায় শায়িত। লুই পঞ্চদশ এটি চার্চ হিসেবে নির্মাণ শুরু করলেও, ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের সময় এটি একটি কবরস্থানে রূপান্তরিত হয়, যেখানে নতুন প্রজাতন্ত্র তাদের গৌরবময় প্রয়াতদের সম্মান জানায়। এখানে শায়িত আছেন ভলতেয়ার, রুশো, ভিক্টর হুগো এবং মেরি কুরি। ২০০২ সালে, জন্মের দুই শতক পরে, অ্যালেকজান্ডার ডুমার দেহাবশেষ তার জন্মস্থান ভিলেয়-কটরেতে থেকে পন্থিয়নে স্থানান্তর করা হয়। আগে তার দেহাবশেষ নরম্যান্ডির পুইস গ্রামের এক সাধারণ কবরস্থান থেকে ভিলেয়-কটরেতে আনা হয়েছিল, যেখানে ১৮৭০ সালে তাকে নিঃশব্দে সমাধিস্থ করা হয়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, “গি দ্য মোপাসাঁর একটি ছোটগল্পের চরিত্রের মতো"। পন্থিয়নের প্রাঙ্গণে সেই বক্তৃতায়, এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব, প্রেসিডেন্ট শিরাক বলেছিলেন, "প্রজাতন্ত্র কেবল ডুমার প্রতিভাকেই সম্মান জানাচ্ছে না... এটি এক ভুল সংশোধন করছে। সেই ভুল, যা তার শৈশব থেকে তাকে চিহ্নিত করেছিল, যেমনটি তার দাস পূর্বপুরুষদের লোহার দাগে চিহ্নিত করা হয়েছিল।"
শিরাক যে দাস পূর্বপুরুষদের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডুমার ঠাকুরমা, একজন স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গ দাস, যিনি হাইতির (তৎকালীন ফরাসি উপনিবেশ) বাসিন্দা ছিলেন। ডুমার দাদু ছিলেন নর্ম্যান্ডির এক অভিজাত ব্যক্তি, মার্কুইস অঁতোয়ান-আলেকজান্দ্রে দাভি দ্য লা পাইলেতেরি। অন্যান্য অনেকের মতো, তিনিও সেসময়ে উপনিবেশে ভাগ্য অন্বেষণে যান। সেখানে তিনি একটি বাগান কিনেছিলেন এবং ১৭৬২ সালের ২৭ মার্চ, তার একটি পুত্রসন্তান জন্মায়, যার মা ছিলেন ওই বাগানের শ্রমিক মেরি-সেসেত ডুমা।
অঁদ্রে মোরোয়া, ডুমার জীবনীকার লিখেছেন, যে পুত্রটির ব্যাপ্টিস্ট করা হয়েছিল তার বাবা-মা'র বিয়ের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মেরি-সেসেত দশ বছর পরে মারা যান, আর মার্কুইস তার পুত্র থমাস-আলেকজান্দ্রেকে নিয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসেন।
১৭৮৯ সালের বিপ্লবের সময় মার্কুইস তার সম্পত্তি হারান, কিন্তু তার পুত্র, যিনি তার মায়ের কুমারী নাম (ডুমা) নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, নেপোলিয়নের গৌরবময় সময়ে বীরত্বের পরিচয় দেন এবং মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে জেনারেল হন। তিনি বিয়ে করেন মেরি-লুইস এলিজাবেথ লাবুরেকে, যিনি ভিলেয়-কটরেতে এক সরাইখানার মালিকের কন্যা ছিলেন। সেখানেই ১৮০২ সালে তাদের পুত্র, ভবিষ্যতের দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো এবং দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স-এর লেখক, অ্যালেকজান্ডার ডুমার জন্ম হয়।
বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সে, একজন অভিজাত কিন্তু প্রজাতন্ত্রপন্থী জেনারেল এবং একটি প্রাদেশিক ছোট-বুর্জোয়া পরিবারের কন্যার সন্তান হিসেবে ডুমা শ্রেণি-সমন্বয়ের এক প্রতীক হয়ে ওঠেন। তার সামাজিক শিকড় তার নাটক এবং উপন্যাসের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়, যেখানে চাকর থেকে শুরু করে চোরাচালানকারী, নাবিক, মাস্কেটিয়ার, কার্ডিনাল এবং রাজাদেরও স্থান ছিল।
ডুমা তার মেমোয়ার্স-এ লেখেন:"আমি দুই প্রাথমিক উপাদানে গঠিত—একটি অভিজাত, যা আমি পেয়েছি আমার পিতার মাধ্যমে; অন্যটি সাধারণ, যা আমি পেয়েছি আমার মায়ের মাধ্যমে। আমার হৃদয়ে যে সম্মানজনক প্রশংসা এবং অসহায়দের জন্য গভীর সহানুভূতি, তা আর কেউ একত্রে বহন করে না।"
একুশ বছর বয়সে, তার সুন্দর হাতের লেখা এবং পিতার প্রভাবশালী অভিজাত সংযোগের কারণে, অ্যালেকজান্ডার ডুমা লুই-ফিলিপ, ডিউক দ’অর্লেয়াঁ এবং ভবিষ্যৎ ফ্রান্সের রাজা, তার সচিবালয়ে একজন কেরানির চাকরি পান।
এই তরুণ প্রাদেশিক লেখক তখন পরিচিত হন সাহিত্যিক স্যালন এবং রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে, যারা ফরাসি ক্লাসিকিজমের সেকেলে রীতিগুলোকে ভেঙে দিচ্ছিল এবং রক্ষণশীল সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্ব্যবহারিক প্রচেষ্টাকে বিপর্যস্ত করছিল।
এটি ছিল ডুমার জীবনের প্রাথমিক সময়, যখন তিনি বই পড়ায় নিমগ্ন, একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তির মতো, তিনি সবকিছু পড়তে থাকেন এবং রোমান্টিকদের মতো, শিলার, গ্যেটে এবং ওয়াল্টার স্কটের লেখাও পড়েন। ওয়াল্টার স্কট বিশেষ করে তার ফরাসি ঐতিহাসিক উপন্যাসের উদ্ভাবনে গভীর প্রভাব ফেলেন। এই সময় ডুমার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো, যা অনেকের মতে ডুমার সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারায় পড়ে না। ডুমা নিজে একে সমকালীন উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এটি ফরাসি ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল বা ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা নয়। বরং এর উৎস এক অদ্ভুত এবং কিছুটা চমকপ্রদ বিবরণ, যা ডুমা জ্যাক প্যুশের Mémoires historiques tirés des archives de la police de Paris থেকে পেয়েছিলেন।
জ্যাক প্যুশে ছিলেন প্যারিসের প্রিফেকচারের একজন আর্কাইভিস্ট, যিনি সবচেয়ে অদ্ভুত এবং কুখ্যাত মামলাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো Historical Memoirs Taken from the Archives of the Paris Police-এ সংকলিত করেন। এই বিচিত্র ঘটনাগুলোর মধ্য থেকেই ডুমা উপন্যাসের মূল কাহিনির সন্ধান পান। এই উপন্যাস, তাই, ঐতিহাসিক নয় বরং মানুষের আচরণ ও জীবনের জটিলতার অনুসন্ধান।
১৮৪৩ সালে, অ্যালেকজান্ডার ডুমা প্রকাশক বেতুন ও প্লনের সঙ্গে একটি চুক্তি করে Impressions de voyage dans Paris নামে আট খণ্ডের একটি সিরিজ প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। প্রথম খণ্ড লেখার কাজ শুরু করার সময়, ডুমার প্রকাশকরা ইউজেন সুয়ের Les Mystères de Paris উপন্যাসের ধারাবাহিক সাফল্যে মুগ্ধ হন। তারা ডুমাকে অনুরোধ করেন এমন কিছু লেখার জন্য, যা পাঠকপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনেও সফল হবে। ডুমা সানন্দে এই অনুরোধ গ্রহণ করেন।
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো ফ্রাঁসোয়া পিকো নামক এক ব্যক্তির বাস্তব জীবনের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত। অ্যালেকজান্ডার ডুমা এই কাহিনি পেয়েছিলেন জ্যাক প্যুশে নামক এক প্রাক্তন পুলিশ আর্কাইভিস্টের লেখা একটি অপরাধ সংকলন থেকে, যা ছিল ‘Historical Memories from the Archives of the Paris Police’ (১৮৩৮)।
পেঙ্গুইন সংস্করণের ভূমিকায় লেখক রবিন বাস এই মামলার একটি চমৎকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন।
পিকো ছিলেন একজন ফরাসি দর্জি, যিনি ১৮০৭ সালে তার বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। তারা তাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেন এবং পিকোকে ৭ বছর কারাগারে কাটাতে হয়। বন্দিত্বের সময়, পিকো এক বৃদ্ধ সহবন্দির কাছ থেকে ধনসম্পত্তির তথ্য পান। মুক্তি পাওয়ার পর, সেই ধন সম্পদ উদ্ধার করে পিকো তার জীবনকে প্রতিশোধের একমাত্র লক্ষ্য করে তোলেন।
ডুমা এই কাহিনির প্রকৃত ঘটনাকে কল্পনার মিশ্রণে উপন্যাসে রূপান্তরিত করেন, যা তাকে এক কালজয়ী রোমাঞ্চকর সাহিত্যে পরিণত করে।
এই ঘটনা দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো-এর গল্পের মূল কাঠামোর সঙ্গে বেশ মিল রাখে, তার সব চমকপ্রদ মোড় ও টানটান উত্তেজনাসহ। তবে এটি কোনো যাদুকরী ফর্মুলা নয়। এমন একটি কাহিনিকে ১৭৬ বছর ধরে স্থায়ী একটি ক্লাসিকে রূপান্তর করতে গেলে ব্যাপক অভিযোজন এবং সৃজনশীল শক্তির প্রয়োজন।
বাস্তব জীবনের অনেক আকর্ষণীয় কাহিনি লেখার জন্য অপেক্ষা করছে, যা উদীয়মান লেখকদের হাতে রূপ নিতে পারে। তাদের কেবল একটি বেছে নিয়ে এটিকে একটি আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর গল্পে পরিণত করতে হবে। তবে, বলা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন। এমন একটি গল্পে প্রাণসঞ্চার করতে হলে লেখকের দক্ষতা, কল্পনা, এবং আবেগকে একই সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো তার এক অনন্য উদাহরণ।
অ্যালেকজান্ডার ডুমা, একজন অসাধারণ গল্পকার, প্রায়ই তার কাজের জন্য সহযোগীদের সাহায্য নিতেন। দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টোলেখার সময় তিনি কাজ করেছিলেন অগাস্ট ম্যাকুয়েটের সঙ্গে, যিনি গল্পের কাঠামো এবং গবেষণার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
ম্যাকুয়েট প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করতেন, যেখানে ডুমা তার কল্পনার দক্ষতা ও সাহিত্যিক শৈলী ব্যবহার করে গল্পকে আরও জীবন্ত ও নাটকীয় করে তুলতেন। এই সহযোগিতা ডুমার জন্য কাজের গতি বাড়িয়েছিল এবং তার অনেক বিখ্যাত কাজের পেছনে ম্যাকুয়েটের অবদান ছিল। তবে ডুমার সৃজনশীলতা এবং ভাষার অনন্য ক্ষমতাই প্রতিটি উপন্যাসকে অমর করে তুলেছিল।
ম্যাকুয়েটের ভূমিকা সত্ত্বেও, উপন্যাসটির মূল কৃতিত্ব ডুমার। তার সাহিত্যিক প্রতিভা এই গল্পকে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তাই এনে দেয়নি, বরং এটিকে একটি কালজয়ী ক্লাসিকের মর্যাদা দিয়েছে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, অ্যালেক্সান্ডার ডুমা তার বিলাসবহুল জীবনযাপন ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের কারণে আর্থিক সংকটে পড়েন। ১৮৪৭ সালে, তিনি প্যারিসে থিয়েটার হিস্টরিক উদ্বোধন করেন, যেখানে তার নিজের নাটক মঞ্চস্থ হত। তবে, ১৮৪৮ সালের বিপ্লব তার আর্থিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং ১৮৫০ সালের মধ্যে থিয়েটারটি দেউলিয়া হয়ে যায়।
একই সময়ে, ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে, ডুমা বিলাসবহুল ভবন Château de Monte-Cristo নির্মাণ করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এবং ঋণের চাপ তাকে ১৮৪৮ সালে নামমাত্র ৩১,০০০ ফ্রাঁর বিনিময়ে বিক্রি করতে বাধ্য করে।
এই আর্থিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ১৮৫০ সালে ডুমাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। ঋণদাতাদের এড়াতে এবং নেপোলিয়ন তৃতীয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে তিনি ১৮৫১ সালে ব্রাসেলস পালিয়ে যান।
তবু, এই প্রতিকূলতার মধ্যেও ডুমা তার সাহিত্যিক কাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীতে প্যারিসে ফিরে এসে লেখালেখি পুনরায় শুরু করেন। ডুমা ইউরোপজুড়ে ভ্রমণ এবং লেখালেখি চালিয়ে যান। যদিও লেখার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়, এই সময় তিনি ছয়টি নাটক, তেরোটি উপন্যাস, কয়েকটি ছোট গল্প, নেপলসের বোরবনদের উপর একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৮৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর, ডুমা ডিয়েপে মৃত্যুবরণ করেন। তার দৃঢ়তা এবং বিপুল সাহিত্যিক অবদান তাকে ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
… এভাবেই আমার লেখার সমাপ্তি! 🌟
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো প্রসঙ্গে কিছু বই:
হেমিংস, এফ. ডব্লিউ. জে.: The King of Romance, হামিশ হ্যামিলটন, লন্ডন, ১৯৭৯।
মোরোয়া, অঁদ্রে: Three Musketeers. A Study of the Dumas Family, অনুবাদ: জেরার্ড হপকিন্স, জোনাথন কেপ, লন্ডন, ১৯৫৭।
সচপ, ক্লদ: Alexandre Dumas. Genius of Life, অনুবাদ: এ. জে. কচ, ফ্র্যাঙ্কলিন ওয়াটস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮।
স্টো, রিচার্ড: Dumas, টুয়েন পাবলিশার্স, বোস্টন, ১৯৭৬।
একো, উমবের্তো: The Cult of the Imperfect. দ্য প্যারিস রিভিউ, ২০১৯।
দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো পড়ার পরে আরও যেসব বই পড়া যেতে পারে:
A Place of Greater Safety - Hilary Mantel: একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস যা ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে লেখা।
Scaramouche - Rafael Sabatini: এক বিদ্রূপাত্মক এবং অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ক্লাসিক।
Black Count - Tom Reiss: অ্যালেক্সান্ডার ডুমার পিতার জীবন নিয়ে লেখা একটি জীবনীমূলক গ্রন্থ।
Mathias Sandorf - Jules Verne: প্রতিশোধ এবং অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে জুল ভার্নের উপন্যাস। যা দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো'র অনুপ্রেরণায় রচিত।
The Scarlet Pimpernel - Baroness Orczy: বিপ্লবকালীন ফ্রান্সে সাহসী উদ্ধারকারীর গল্প।
The Last Cavalier - Alexandre Dumas: ডুমার একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস যা বহু বছর পরে আবিষ্কৃত হয়।
The Arabian Nights V3 - Penguin Classic: এক হাজার এক রাত্রির গল্পের তৃতীয় খণ্ড।
The Mysteries of Paris - Eugene Sue (Penguin Classic): উনিশ শতকের ফরাসি সমাজের একটি চিত্র।
Armaddale - Wilkie Collins: উইলকি কলিন্সের রহস্য এবং মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।
Caleb Williams - William Godwin: রাজনৈতিক এবং সামাজিক দার্শনিক উপন্যাস।
The Mysteries of Udolpho - Ann Radcliffe: গথিক সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক।
উপন্যাসটি থেকে আমার কিছু প্রিয় উক্তি:
১. "পৃথিবীতে সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই; আছে শুধু এক অবস্থার সঙ্গে অন্য অবস্থার তুলনা। যে ব্যক্তি গভীরতম দুঃখ অনুভব করেছে, সে-ই প্রকৃত সুখের স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম।"
২. "সমস্ত মানবজ্ঞান এই দুটি শব্দে নিহিত—অপেক্ষা করো এবং আশা রাখো।"
৩. "দেশদ্রোহিতা আর দেশপ্রেমের মধ্যে পার্থক্য কেবল সময়ের ব্যাপার।"
৪. "আমাদের হারানো বন্ধুরা মাটির নিচে নয়, তারা আমাদের হৃদয়ের গভীরে শায়িত। তারা আমাদের সঙ্গেই থাকে, এইভাবেই নিয়তি নির্ধারণ করেছে।"
৫. "কলম, কালি আর কাগজের প্রতি সবসময়ই আমার ভয় ছিল তলোয়ার বা পিস্তলের চেয়ে বেশি।"
৬. "যারা জন্মগতভাবে সম্পদশালী এবং নিজেদের ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা রাখে, তারা জীবনের প্রকৃত সুখ বোঝে না। ঠিক যেমন তীব্র ঝড়ের মাঝে ভঙ্গুর ভেলায় ভাসমানরা শান্ত আবহাওয়ার মূল্য বুঝতে পারে।"
৭. "আমি মনে করি না যে মানুষ সহজে সুখ লাভের জন্য তৈরি। সুখ পরির গল্পের সেই প্রাসাদের মতো, যার দরজায় ড্রাগন পাহারা দেয়। এটিকে জয় করতে হলে লড়াই করতেই হবে।"
৮. "মনে রাখো, যা একবার করা সম্ভব হয়েছে, তা আবারও করা সম্ভব।"
৯. "এখন বিদায় নিলাম দয়া, মানবতা এবং কৃতজ্ঞতার কাছ থেকে। আমি নিজেকে প্রভিডেন্সের স্থলাভিষিক্ত করেছি সৎ কাজের পুরস্কার দিতে; এখন ঈশ্বরের প্রতিশোধের স্থানে আমি দাঁড়াতে চলেছি পাপীদের শাস্তি দিতে।"
১০. "মানুষ কখনোই পরিপূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না সে সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে। ধ্বংসের জ্ঞান অর্জন করেছে, সেটাই অর্ধেক যুদ্ধ জিতে নেওয়ার সমান।"
১১. "যে গভীর দুঃখ অনুভব করেছে, সেই প্রকৃত সুখের স্বাদ পেতে পারে।"
১২. "তোমার জীবনের গল্প একটি উপন্যাস। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মানুষ পাণ্ডুলিপিতে বাঁধা উপন্যাস ভালোবাসে, অথচ জীবন্ত গল্পে সন্দেহ করে।"
১৩. "আমরা প্রায়ই সুখের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যাই, কিন্তু তা দেখি না, গুরুত্ব দিই না। আর যদি দেখি বা গুরুত্ব দিই, তাও হয়তো তা চিনতে পারি না।"
১৪. "আহ," জেলারের কথা, "যা অসম্ভব, তা নিয়ে বেশি ভাবো না, নইলে দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাগল হয়ে যাবে।"
১৫. "ঈশ্বর সবসময় শেষ আশ্রয়স্থল। দুর্ভাগারা, যাদের শুরুতেই ঈশ্বরের উপর নির্ভর করা উচিত ছিল, তারা মুক্তির অন্য সকল পথ শেষ করে ঈশ্বরের দিকে ফিরে চায়।"
১৬. "আমি ভূতের ভয় করি না। আর কখনো শুনিনি যে ছয় হাজার বছরে মৃতেরা যতটা ক্ষতি করেছে, জীবিতেরা একদিনেই তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেনি।"
১৭. "আমার সন্তান, দর্শন কোনো নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ নয় যা শিখিয়ে দেওয়া যায়; এটি সব জ্ঞানের সমন্বয়, সেই সোনালি মেঘ যা আত্মাকে স্বর্গে পৌঁছে দেয়।"
১৮. "হ্যাঁ, আমি একটি কার্গো অফিসার; কলম, কালি আর কাগজই আমার হাতিয়ার, আর আমার হাতিয়ার ছাড়া আমি অকর্মণ্য।"
১৯. "সত্য মহান। আগুন তা পোড়াতে পারে না, আর জল তা ডুবিয়ে দিতে পারে না।"
২০. "মানুষ সবসময় সুখী হতে তাড়াহুড়ো করে।"
২১. "ঈশ্বর কখনো কখনো কিছুক্ষণ ভুলে থাকেন, যখন তার বিচার বিশ্রামে থাকে। তবে সেই মুহূর্ত অবশ্যই আসে, যখন তিনি আবার মনে করেন।"
২২. "ড্যাংলার্স [ব্যাঙ্কার] এমন এক ব্যক্তি, যার কানের পেছনে কলম আর হৃদয়ের জায়গায় কালি পাত্র। তার কাছে সবই যোগ-বিয়োগের অঙ্ক।"
২৩. "জীবন কী? এটি কি মৃত্যুর প্রাক্কালে এক হলঘর নয়?"
২৪. "আর কিছু বলো না, অনুরোধ করছি। আমি যা খুশি করি, মঁসিয়র বোশ্যাঁ, এবং যা করি তা সবসময় ভালো।""স্যার," যুবকটি উত্তর দিল, "সৎ মানুষদের এমন মুদ্রায় পুরস্কৃত করা হয় না।"
অ্যালেকজান্ডার ডুমা'র জীবনের ক্রমানুসার:
১৮০২: অ্যালেকজান্ডার ডুমার জন্ম ভিলেয়-কটরেতে, থমাস-অ্যালেকজান্ডার ডুমার তৃতীয় সন্তান হিসেবে। তার পিতা, যিনি নিজেই এক মার্কুইস এবং স্যান ডমিনগোর এক দাসীর অবৈধ সন্তান, রিপাবলিকান এবং পরে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর একজন অসাধারণ জেনারেল ছিলেন।
১৮০৬: জেনারেল ডুমার মৃত্যু। ডুমা এবং তার মা, এলিজাবেথ লাবুরে, অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন।
১৮২২: ডুমা একজন কেরানি হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং ১৮২৩ সালে ডিউক অফ অর্লেয়াঁর স্টাফে একটি সুবিধাজনক পদ পান। এই সময় তিনি অভিনেতা তালমার সঙ্গে পরিচিত হন এবং শিল্প-সাহিত্যিক মহলে মেলামেশা শুরু করেন। জনপ্রিয় থিয়েটারের জন্য স্কেচ লেখা শুরু করেন।
১৮২৪: সেলাইকারিগর ক্যাথরিন লেবের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে তার পুত্র অ্যালেকজান্ডার ডুমা (পরে লা দাম ও ক্যামেলিয়াস এর লেখক) জন্মগ্রহণ করেন।
১৮২৯: ডুমার ঐতিহাসিক নাটক Henri III et sa cour কমেডি-ফ্রঁসেজ-এ মঞ্চস্থ হয়। এটি তাত্ক্ষণিক সাফল্য লাভ করে এবং রোমান্টিক আন্দোলনের একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডুমাকে প্রতিষ্ঠা করে।
১৮৩০: ভিক্টর হুগোর নাটক Hernani রোমান্টিক এবং ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যের মধ্যে সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। জুলাই মাসে, বোরবন রাজতন্ত্র উৎখাত হয় এবং অর্লেয়ানিস্ট রাজা লুই-ফিলিপের নেতৃত্বে নতুন শাসন শুরু হয়। ডুমা এই বিদ্রোহকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন।
১৮৩১: ডুমার মেলোড্রামা Antony, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র আদর্শিক রোমান্টিক নায়ক, থিয়েটার দ্য লা পোর্ট সেন্ট-মার্টিন-এ বিশাল সাফল্য লাভ করে।
১৮৩২: সুইজারল্যান্ড ভ্রমণে যান, যা তার প্রথম ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের উৎস। এই বইটি পরবর্তী বছরে প্রকাশিত হয়।
১৮৩৫: নেপলস ভ্রমণ করেন ইডা ফেরিয়ারের সঙ্গে (যাকে তিনি পরে বিয়ে করবেন)। নেপলসে ক্যারোলিন উঙ্গারের সঙ্গে এক আবেগময় সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ইতালি ও ভূমধ্যসাগরের প্রেমে পড়েন।
১৮৩৬: ডুমার নাটক Kean, যা ইংরেজ অভিনেতা এডমন্ড কিনের ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে রচিত, বিরাট সাফল্য অর্জন করে। ডুমা ১৮২৮ সালে কিনকে শেকসপিয়ারের নাটকে অভিনয় করতে দেখেছিলেন।
১৮৩৯: তার নাটক Mademoiselle de Belle-Isle থিয়েটারে ডুমার সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে স্বীকৃত হয়।
১৮৪০: ডুমা ইডা ফেরিয়ারকে বিয়ে করেন। রাইনের তীর ধরে ভ্রমণ করেন জেরার দ্য নেরভালের সঙ্গে এবং Léo Burckart নাটকটি যৌথভাবে লেখেন। নেরভাল তাকে অগুস্ত মাকেতে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি ডুমার ভবিষ্যতের অনেক কাজের সহযোগী হন।
১৮৪১: ফ্লোরেন্সে এক বছর কাটান।
১৮৪৪: ডুমার দুই শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের বছর। মার্চ মাসে The Three Musketeers ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয় এবং আগস্টে The Count of Monte Cristo-এর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। ডুমা Château de Monte-Cristo নির্মাণ শুরু করেন এবং ইডা ফেরিয়ারের সঙ্গে আলাদা হয়ে যান।
১৮৪৫: The Three Musketeers-এর প্রথম সিক্যুয়েল Twenty Years After বছরের শুরুতে প্রকাশিত হয়। ফেব্রুয়ারিতে, ডুমা তার বিরুদ্ধে সাহিত্য চুরির অভিযোগের মামলা জিতে যান। La Reine Margot প্রকাশিত হয়।
১৮৪৬: ডুমা স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। La Dame de Monsoreau, Les Deux Diane, এবং Joseph Balsamo প্রকাশ করেন।
১৮৪৭: ডুমার থিয়েটার থিয়েটার হিস্টরিক উদ্বোধন হয়, যেখানে তার উপন্যাসগুলোর নাট্যরূপ প্রদর্শিত হয়, যেমন The Three Musketeers এবং La Reine Margot। ধারাবাহিক আকারে The Vicomte de Bragelonne প্রকাশ শুরু হয়, যা The Three Musketeers-এর শেষ অধ্যায়।
১৮৪৮: ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবের ফলে লুই-ফিলিপ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ডুমা সংসদের সদস্য পদে দাঁড়ালেও ব্যর্থ হন এবং লুই-নেপোলিয়নকে সমর্থন করেন, যিনি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হন।
১৮৪৯: ডুমা The Queen’s Necklace প্রকাশ করেন।
১৮৫০: ডুমাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। তিনি Château de Monte-Cristo এবং থিয়েটার হিস্টরিক বিক্রি করতে বাধ্য হন। The Black Tulip প্রকাশ করেন।
১৮৫১: ডিসেম্বরে লুই-নেপোলিয়ন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রজাতন্ত্র কার্যত বিলুপ্ত হয়। এক বছর পরে দ্বিতীয় সাম্রাজ্য ঘোষণা করা হয়। ভিক্টর হুগো বেলজিয়ামে নির্বাসনে যান, এবং ডুমা তার ঋণদাতাদের এড়াতে সেখানে যোগ দেন।
১৮৫২: ডুমা তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেন।
১৮৫৩: নভেম্বরে প্যারিসে ফিরে Le Mousquetaire নামে একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং Ange Pitou প্রকাশ করেন।
১৮৫৮: Le Monte-Cristo নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। নয় মাসের রাশিয়া ভ্রমণে যান।
১৮৬০: গারিবালদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইতালীয় সংগ্রামকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। L’Independente নামে একটি পত্রিকা চালু করেন, যা ইতালীয় ও ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হত। গারিবালদি ডুমার এমিলি কর্ডিয়ারের কন্যার গডফাদার হন।
১৮৬১–১৮৭০: ডুমা ইউরোপজুড়ে ভ্রমণ এবং লেখালেখি চালিয়ে যান। যদিও লেখার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়, এই সময় তিনি ছয়টি নাটক, তেরোটি উপন্যাস, কয়েকটি ছোট গল্প, নেপলসের বোরবনদের উপর একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি আমেরিকান আদাহ মেনকেনের সঙ্গে তার শেষ সম্পর্ক তৈরি করেন এবং নাটক, ভ্রমণ ও রন্ধনের প্রতি তার আজীবনের ভালোবাসা উপভোগ করেন।
১৮৭০: ৫ ডিসেম্বর, ডুমা ডিয়েপে মৃত্যুবরণ করেন।
চরিত্রের তালিকা (দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো)
এডমন্ড দান্তেস: ⚓ মার্সেইয়ের নাবিক, ফারাও জাহাজের সঙ্গী। পরে মন্টে ক্রিস্টোর কাউন্ট হয়ে ওঠেন, বিভিন্ন সময়ে লর্ড উইলমোর, আবে বুসোনি, এবং সিনবাদ দ্য সেলর নামে পরিচিত।
লুই দান্তেস: 👴 এডমন্ড দান্তেসের বাবা।
মার্সেডেস: 💔 এক কাতালান নারী, এডমন্ড দান্তেসের বাগদত্তা।
ফার্নান্দ মনডেগো: 🗡️ মার্সেডেসের চাচাতো ভাই, পরে কমতে দ্য মোরসেফ উপাধি লাভ করেন।
ভিকমত আলবে দ্য মোরসেফ: 👦 ফার্নান্দের পুত্র।
ড্যাংলার্স: 💼 ফারাও জাহাজের সুপারকার্গো, পরে প্যারিসের ব্যাঙ্কার এবং ব্যারন ড্যাংলার্স।
ব্যারনেস ড্যাংলার্স: 👒 ড্যাংলার্সের স্ত্রী।
মাদমোয়াজেল ইউজেনি ড্যাংলার্স: 🎻 ড্যাংলার্সের কন্যা।
লুইস দ’আর্মিলি: 🎼 ইউজেনি ড্যাংলার্সের বন্ধু এবং তার সংগীত শিক্ষক।
মঁসিয়ে মোরেল: ⚓ ফারাও জাহাজের মালিক।
মাদাম মোরেল: 👩👧 মঁসিয়ে মোরেলের স্ত্রী।
ম্যাক্সিমিলিয়ান মোরেল: 🛡️ মঁসিয়ে এবং মাদাম মোরেলের পুত্র।
জুলি মোরেল: 🌹 তাদের কন্যা।
এমানুয়েল হারবোঁ: 📜 মোরেল অ্যান্ড সন প্রতিষ্ঠানের একজন কেরানি।
ককলেস: 🖋️ মোরেল অ্যান্ড সনের আরেকজন কেরানি।
গাসপার্ড ক্যাডরুস: 🧵 মার্সেইয়ের এক দর্জি, পরে পন্ট দ্য গার্ড ইন-এর মালিক।
মাদেলেইন (লা কারকন্তে): 🏚️ ক্যাডরুসের স্ত্রী।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট: 👑 ফরাসি সম্রাট।
লুই অষ্টাদশ: 🤴 ফ্রান্সের রাজা।
ব্যারন ডান্দ্রে: 🕵️ পুলিশ মন্ত্রী।
ডিউক দ্য ব্লাকাস: ⚜️ রাজতন্ত্রের সমর্থক।
মঁসিয়ে নোয়ারতিয়ে দে ভিলফোর: 🐦 নেপোলিয়নের সমর্থক।
মঁসিয়ে জেরার দে ভিলফোর: ⚖️ নোয়ারতিয়ের পুত্র, রাজপ্রসাদের প্রসিকিউটর।
মারকুইস দ্য সেন্ট-মেরান: 👑 ভিলফোর পরিবারের একজন অভিজাত সদস্য।
মারকুইস দ্য সেন্ট-মেরান: 👒 তার স্ত্রী।
মাদমোয়াজেল রেনি দ্য সেন্ট-মেরান: 💍 তাদের কন্যা, মঁসিয়ে জেরার দে ভিলফোরের বাগদত্তা।
কমতে দে সালভিউ: 🏛️ মঁসিয়ে দ্য সেন্ট-মেরানের পিতা।
জেনারেল ফ্লাভিয়েন দে কেসনেল: 🎖️ বোনাপার্টের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
ব্যারন ফ্রাঁজ দ’এপিনে: 🛡️ জেনারেল দে কেসনেলের পুত্র।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুই জ্যাক বোঅরেপেয়ার: 🎖️ বোনাপার্টীয় দলের সদস্য।
ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল এতিয়েন দ্য শম্পি: 🛡️ বোনাপার্ট সমর্থক।
ক্লদ লেশারপাল: 🌲 বনের রক্ষক এবং রু সেন্ট জ্যাকের বোনাপার্ট ক্লাবের সদস্য।
মারেশাল বার্ট্রান্ড: 📜 উপন্যাসের এক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক চরিত্র।
মঁসিয়ে দে বোভিল: 🔍 কারাগারের পরিদর্শক।
চাতো দ্য’ইফ-এর গভর্নর: 🏰 চাতো দ্য’ইফ কারাগারের প্রধান।
আবে ফারিয়া: 📖 চাতো দ্য’ইফ কারাগারের এক বন্দি, যিনি এডমন্ড দান্তেসের জন্য মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন।
একজন জেলর: 🛡️ চাতো দ্য’ইফ কারাগারের একজন প্রহরী।
মার্সেইয়ের মেয়র: 🏛️ শহরের প্রশাসনিক প্রধান।
ক্যাপ্টেন বালদি: ⚓ লা জ্যোন আমেলি নামের জেনোইজ চোরাচালানকারী জাহাজের অধিনায়ক।
জ্যাকোপো: 🛶 ক্যাপ্টেন বালদির নাবিক দলের একজন বিশ্বস্ত সদস্য।
মেত্রে পাস্ত্রিনি: 🏨 রোমের হোটেল দ্য লন্ড্রেস-এর মালিক।
গায়েতানো: ⚓ একজন রোমান নাবিক।
কুকুমেত্তো: 🔫 এক ডাকাত দলের নেতা।
কার্লিনি এবং দিয়াভোলাচ্চিও: ⚔️ কুকুমেত্তোর দলের সদস্য।
রিতা: 💘 কার্লিনির বাগদত্তা।
লুইজি ভাম্পা: 🌲 এককালে মেষপালক, পরে রোমান ডাকাতদের নেতা।
তেরেসা: 💍 লুইজি ভাম্পার বাগদত্তা।
পেপ্পিনো: 🐑 একজন মেষপালক।
আন্দ্রেয়া রনডোলা: ⚔️ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক খুনি।
কমতে দ্য সান ফেলিচে: 🏛️ রোমান অভিজাত ব্যক্তি।
ডিউক দ্য ব্রাচ্চিয়ানো: 👑 আরেকজন রোমান অভিজাত।
কারমেলা: 🌹 কমতে দ্য সান ফেলিচের কন্যা।
কমতেস গুইচ্চিওলি: 👒 একটি রোমান পরিবারের উল্লেখযোগ্য সদস্য।
মেজর বার্তোলোমেও কাভালকান্তি: 🌍 এক অভিযাত্রী।
বেনেদেত্তো: 🕵️ আন্দ্রেয়া দে কাভালকান্তি নাম নিয়ে পরিচিত এক প্রতারক।
মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্যব্রে: 🖋️ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।
মঁসিয়ে বোশ্যাঁ: 📖 একজন সম্পাদক।
শাতো-রেনো: 🤝 আলবে দে মোরসেফের বন্ধু।
হেলোইজ: 👩🦳 ভিলফোরের দ্বিতীয় স্ত্রী।
এদুয়ার: 👦 হেলোইজ এবং ভিলফোরের পুত্র।
মাদমোয়াজেল ভ্যালেন্টিন: 💕 ভিলফোরের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে, ম্যাক্সিমিলিয়ান মোরেলের প্রতি ভালোবাসায় মগ্ন।
ডক্টর দ্য’অ্যাভ্রিগনি: ⚕️ ভিলফোর পরিবারের চিকিৎসক।
মঁসিয়ে দ্যশ্যাঁ: 📜 একজন নোটারি।
আলি তেবেলিন: 🗡️ জানিনার পাশা।
ভাসিলিকি: 👑 আলি পাশার স্ত্রী।
হায়দে: 👸 আলি পাশা এবং ভাসিলিকির কন্যা।
সেলিম: 🌟 আলি পাশার প্রিয়পাত্র।
বার্তুচ্চিও: 🏠 মন্টে ক্রিস্টোর কাউন্টের তত্ত্বাবধায়ক।
আসুন্তা: 🍞 বার্তুচ্চিওর শ্যালিকা।
বাপতিস্তিন: 🤵 মন্টে ক্রিস্টোর বিশ্বস্ত চাকর।
আলি: 🤫 একজন নুবিয়ান মূক দাস, মন্টে ক্রিস্টোর অনুগত।
আবে অ্যাডেলমন্টে: ✝️ একজন সিসিলীয় পাদ্রি।
জার্মেইন: 👔 আলবে দে মোরসেফের চাকর।
এতিয়েন: 🖋️ ড্যাংলার্সের চাকর।
বারোয়া: 🛡️ নোয়ারতিয়ের পরিচারক।
ফানি: 👩🦱 মাদমোয়াজেল দে ভিলফোরের দাসী।
পেরে পামফিল: 🏨 লা রিজার্ভ ইন-এর মালিক।
ক্যাপ্টেন লেক্লার্ক: ⚓ ফারাও জাহাজের অধিনায়ক।
পেনেলন: ⛵ ফারাও জাহাজের একজন নাবিক।
ক্যাপ্টেন গোমার্ড: 🚢 মঁসিয়ে মোরেলের জাহাজে অধিনায়ক।
জোয়ানেস: 💎 একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী।