দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ
অনুবাদ ও সম্পাদনা: অরুণাভ সিনহা / একটি যুগান্তকারী বাংলা সাহিত্য সংকলন, যেখানে ইংরেজিতে প্রথমবারের মতো অনূদিত বহু বাংলা গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ
অনুবাদ ও সম্পাদনা: অরুণাভ সিনহা
একটি যুগান্তকারী বাংলা সাহিত্য সংকলন, যেখানে ইংরেজিতে অনূদিত বহু বাংলা গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইংরেজিতে প্রথমবারের মতো এই সংকলনটি এক শতাব্দীর অসামান্য গল্পগুলোকে একত্রিত করেছে। গোপনে মাছ খাওয়া নারী থেকে স্থানীয় এক বৃদ্ধ ফুটবলারের দুর্দশা, মধ্যবিত্ত শ্রমিক নেতার উদ্বেগ থেকে দার্শনিকের পাথর আবিষ্কারকারী এক আইনজীবীর গল্প—এই সংকলনটি জীবনের সব কঠিন ও আনন্দময় দিককে শিল্পে রূপান্তরিত করেছে।
ভূমিকা
অনুবাদ - রিটন খান
আমি সাহস করে বলবো, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল রত্ন হলো ছোটগল্প। বিশ শতক জুড়ে অসংখ্য পত্রিকা, রবিবারের বিশেষ সংযোজনী ও অসংখ্য সাহিত্য সাময়িকীর প্রাণবন্ত স্রোতে বেড়ে ওঠা এই ছোটগল্প, যখন বিনোদনের আর কোনো দ্রুত মাধ্যম ছিল না, তখন লক্ষ লক্ষ পাঠকের মনোযোগ কেড়েছে। বাংলা সাহিত্যের বহুবিধ গল্পের রূপ ও বৈচিত্র্যকে ছোটগল্পের মতো এমন সুনিপুণভাবে আর কোনো সাহিত্যি আঙ্গিক ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।
মজার বিষয় হলো, বাঙালি মনে মূলত উপন্যাসই গভীরভাবে দাগ কাটে। সম্ভবত এটি সব ভাষার ক্ষেত্রেই সত্য; বহু প্রাচীন উপন্যাস চিরকাল পাঠকের স্মৃতিতে অমলিন থাকে, কিন্তু ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তেমন স্মৃতি খুব কমই থেকে যায়, কয়েকটি বিখ্যাত গল্প ছাড়া। আমি আবারও একই জায়গায় ফিরে আসব এবং বলব যে, বাংলা ছোটগল্পগুলো স্মরণ ও বিস্মরণের দ্বৈতসত্তার জীবন্ত প্রমাণ।
বাংলা ভাষা প্রায় ২৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষা, প্রধানত দু’টি অঞ্চলে – ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশে। এই দুই অঞ্চলই একসময় ঐতিহাসিক বঙ্গপ্রদেশের অংশ ছিল, যদিও এর সীমানা বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে, এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আসার আগেও। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার একটি শাখা থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘটে আসছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং ক্রমে ভারতের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে, তখন বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপের অনেক কাছাকাছি পৌঁছায়। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্গ অঞ্চলে ছাপাখানার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে, ভাষাটির একটি মান্য সংস্করণ তৈরি হতে শুরু করে – যেখানে অবশ্য আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কিছু প্রভাব ছিল – এবং এই ভাষাতেই সাহিত্য রচিত হতে শুরু করে। কালের বিবর্তনে এই রূপটিই টিকে গেছে এবং আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারতের অধিকাংশ সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যও মৌখিক আকারে শুরু হয়, এবং তাই কবিতাই ছিল এর প্রাথমিক মাধ্যম। উনিশ শতকে যখন লেখকরা গদ্যের সম্ভাবনাগুলি আবিষ্কার করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের লেখালেখির এক বিস্ফোরণ ঘটে। এই আকস্মিক সম্ভাবনার বিস্তার থেকেই বাংলা কথাসাহিত্য আত্মপ্রকাশ করে, প্রথমে উপন্যাস আকারে এবং কিছুটা পরে ছোটগল্প হিসেবে। এই আঙ্গিকগুলি পশ্চিম থেকে আগত, কারণ ব্রিটিশ শাসকদের মাধ্যমে কলকাতা – যা আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী – তখনকার ভারতের রাজধানী হওয়ায়, বাংলায় ইংরেজি সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বাংলা ছোটগল্প বিশেষভাবে লক্ষ লক্ষ পাঠকের মন জয় করে নিতে শুরু করে এবং পরবর্তী কয়েক দশক ধরে তা আরও বিস্তৃত হয়। বাংলা নবজাগরণকালে এবং তার পরবর্তী শিক্ষাবিস্তারের কারণে বঙ্গভূমিতে একটি বিশাল শিক্ষিত পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। এই চাহিদার প্রেক্ষাপটে বাংলা কথাসাহিত্যিকরা এক অদম্য উৎসাহে ছোটগল্প রচনা করতে থাকেন, যার ফলে এক ধারাবাহিক কল্পকাহিনি নির্মিত হতে থাকে, যা একদিকে ছিল কল্পনার সৃজন, অন্যদিকে বাস্তব জীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা—এমন এক জগতের অংশ হতে পাঠকেরা সদা আগ্রহী ছিলেন।
বাংলা কথাসাহিত্য সবসময়ই অস্থির সময়ে রচিত হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাঙালিদের জীবনে এমন একটি সময়ও খুঁজে পাওয়া কঠিন, যা ছিল মোটামুটি শান্ত। যখন প্রথম ছোটগল্পগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটে, তখন পুরো ভারতবর্ষ, বিশেষত বাংলা, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিগর্ভে ছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিদায় এবং স্বরাজের অধিকার দাবিতে বাংলা তখন চরম অস্থিরতায় আন্দোলিত। বাংলায় এই আন্দোলন বিশেষত সহিংস রূপ নেয়, যেখানে তরুণ উদ্দীপ্ত বিপ্লবীরা বোমা ও বন্দুককে ব্রিটিশদের ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। তখনো গান্ধীর অহিংস আন্দোলন আসেনি, এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের শৃঙ্খলিত ব্যবস্থার মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার সম্ভাবনায় রোমান্টিক ও বীরত্বপূর্ণ আকর্ষণ ছিল। ‘স্বদেশি’ আন্দোলনও ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশি পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে অর্থনৈতিক যুদ্ধের সূচনা করে—যদিও দেশীয় পণ্য তখন বিলাসবহুল ছিল, কেননা এগুলি ব্রিটিশ পণ্যের চেয়ে অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় তুলনামূলকভাবে ধনী শ্রেণির মধ্যেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। এই ঘটনাগুলি সেই সময়কার বাংলা কথাসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১–১৯৪১) কয়েকটি রচনায়, যিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, এবং তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮–৯৪) রচনায়, যার ঐতিহাসিক উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) প্রথম বাংলা উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। (টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়ে ১৮৫৮-র শেষ দিকে বই রূপে প্রকাশ পায়। বাংলা ১২৯৯ সালে ক্যানিং লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত লুপ্তরত্নোদ্ধার বা ৺প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলী-র যে ভূমিকা বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন, সেখানে তিনি আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসটিকে ‘আদি’ বলে উল্লেখ করেন। - ভূমিকার অনুবাদক)
তবে অস্থিরতার আরও কিছু দিক ছিল, যা সমাজকে মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছিল। জমিহীন কৃষকদের উপর সামন্ত ভূমিরাজদের অব্যাহত শোষণ চলছিল, যা শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই তাদের জন্য চরম দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন তখনো বহু দূরের বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ভারতের জটিল জাতিভেদের নিষ্ঠুর শ্রেণিবিন্যাস, যেখানে তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকেরা কৌশলে দেবত্ব, ক্ষমতা এবং অধিকার দাবির মাধ্যমে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের দমিয়ে রাখত। এই সমস্ত বিষয়গুলি তখনকার গল্পে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখা এই গল্পগুলি সমাজের গভীর অসঙ্গতিগুলিকে উন্মোচিত করতে চেয়েছিল।
পুরুষতন্ত্র তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৪–১৮৩৩) উদ্যোগে সতীদাহ প্রথার বিলোপ, বিধবাবিবাহের স্বীকৃতি, নারীদের শিক্ষার সুযোগ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০–৯১) প্রচেষ্টায় বিয়ের ন্যূনতম বয়স বাড়ানোর মতো কিছু পরিবর্তন এলেও এগুলির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল রক্ষণশীল সমাজ। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আট বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার—নারীদের অধিকার ছিল অপ্রতুল, স্বাধীনতা ছিল একেবারেই অধরা। কেবল সেই নারীরাই সামান্য স্বাধীনতা পেতেন, যাদের পিতা বা স্বামী ছিলেন প্রগতিশীল; তবু সেখানেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পুরুষদের হাতেই ছিল। তাই নারীদের গোপন আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও হতাশার গল্পগুলো সাহিত্যে স্থান পেতে থাকে, যা পাঠকের একাংশকে তাদের জীবনের অপ্রকাশিত সত্যকে এই গল্পগুলির মাধ্যমে খুঁজে পেতে সাহায্য করত। এভাবেই এই গল্পগুলো বিশেষ করে মহিলা পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কারণ তাদের গৃহবন্দী জীবনে গল্পের চরিত্রগুলোর জীবনই ছিল একমাত্র আশ্রয়।
এই কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সেই সময়কার বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ছিল সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের বিভিন্ন রূপ। বিশেষ করে ছোটগল্পকারেরা তাদের চারপাশের বাস্তব জীবনের সুতোয় গল্প বুনতেন। এই গল্পের চরিত্রগুলির যাত্রাপথ—যা কখনো আশার দিকে অগ্রসর হতো, আবার কখনো হতাশার গভীরে ডুবে যেত—ছিল নির্মম বাস্তবতার প্রতিফলন। এই চরিত্রগুলো প্রায়ই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হত, এবং নির্যাতনকারীরাও গল্পে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিছু লেখক তাদের এই কাহিনিগুলিকে ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের সাথে মিশিয়ে তুলতেন, তবে বিশ শতকের ১৯২০ সালের আগে পর্যন্ত বাংলা কথাসাহিত্য ছিল সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার প্রতি নিবেদিত। এই বাস্তবতা এড়ানো সম্ভব ছিল না, বরং তা এড়ানো অনৈতিক বলে বিবেচিত হতো, কারণ অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নির্মম অস্তিত্ব ছিল স্পষ্ট ও অনুভূত এক উপস্থিতি।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার মনে করে যে বাংলায় রাজনৈতিক প্রতিরোধ ক্রমেই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাই আন্দোলনকারীদের বিভক্ত করা প্রয়োজন। সেই কারণে, ব্রিটিশ ভারত সরকার ঘোষণা করে যে বাংলা প্রদেশ ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত হবে—যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলি একটি পৃথক প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি অন্য প্রদেশ হিসেবে থাকবে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে হওয়া বিভাজনের মতো এই পরিকল্পনাও বাংলায় সমর্থন পায়নি। প্রবল এবং সহিংস বিরোধিতা শুরু হয় এবং অল্প সময়েই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবুও, ব্রিটিশরা ১৯১২ সাল পর্যন্ত এই বিভাজন ধরে রাখে এবং পরবর্তীতে বাংলাকে পুনরায় একত্রিত করার ঘোষণা দেয়। এই সাময়িক বিভাজন কিছু অর্থে বাংলা পরিচয়ের ঐক্যকে আরও জোরালো করে তোলে, যা লেখক ও শিল্পীদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের ভিত্তি তৈরি করে। তবে এটি বাংলার প্রধান দুটি ধর্ম—হিন্দু ও ইসলামের মধ্যে বিভেদের সূচনাও ঘটায়। এর আগে থেকেই জাতপাতের ভিত্তিতে বিভাজন ছিল, কিন্তু এখন তাতে ধর্মীয় বিভাজনও যুক্ত হলো, যেখানে ‘জাত’ শব্দটি একইসাথে ধর্ম ও বর্ণকে প্রকাশ করে। এতে হিন্দুদের মধ্যে বর্ণভিত্তিক এবং হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন আরও গাঢ় হয়, যেখানে প্রত্যেক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীকে 'অপর' হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের প্রতি মনোযোগী হয়ে অনেক লেখক তাদের সাহিত্যে এর ব্যক্তিগত প্রভাব অনুসন্ধান করতে শুরু করেন।
পুনর্মিলনের এক বছর আগেই ব্রিটিশ ভারত সরকার রাজধানীকে দেশের পূর্ব প্রান্তের কলকাতা থেকে ভূগোলগতভাবে কেন্দ্রে অবস্থিত দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। শাসকরা তখন আর কলকাতা ও এর আশেপাশের উন্নয়নে আগ্রহী না থাকায়, এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়; ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু, যা বহু মানুষের জন্য সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিল, ধীরে ধীরে দেশের অন্য অংশে, সরকারের নিকটে সরে যেতে থাকে। অন্যদিকে, বোম্বে এবং ভারতের পশ্চিমাংশও নিজেদের বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। এই বৈষম্য স্বাধীনতার পর বাংলায় অর্থনৈতিক হতাশা এবং এর বিরুদ্ধে অসন্তোষের জন্ম দেয়, যা বহুক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল রূপে প্রকাশিত হতে থাকে।
বিশ শতকের প্রথম দিকের দশকগুলোতে বাংলায় বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধি ঘটে, যার পেছনে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দর্শন, শিল্পকলা, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং বিশেষ করে সাহিত্য—এই সকল আধুনিক চিন্তাধারা কলকাতায় প্রবেশ করে এবং দ্রুত বিস্তৃত হয়। দীর্ঘকাল রাজধানী হিসেবে থাকা কলকাতা বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে, যা বিভাজনের পরেও অক্ষুণ্ণ থাকে; এমনকি ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করার পরেও। এর ফলে, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখকরা বিভিন্ন সময়ে কলকাতার প্রতি আকৃষ্ট হন। যদিও অনেকে গ্রামীণ বা আধা-গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, তাদের প্রায় সব লেখাই কলকাতার পত্রিকা ও বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।
বাইরের চিন্তাধারা গ্রহণ করে, অনেক চিন্তাশীল নারী-পুরুষ সমাজতন্ত্রের এবং পরে মার্ক্সবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা তাদের চারপাশের সমাজ ও পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন, এবং অনেক লেখক তাদের গল্পে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেন। পূর্বসূরিদের মতো তারা নির্যাতিত মানুষের কথা লেখেন, তবে তাদের গল্পগুলো মানবিক নিপীড়নের চেয়ে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থার নির্যাতনকে প্রকাশ করে, যার নির্মম প্রভাব মানুষের জীবনে সরাসরি অনুভূত হয়, কোনো সুকৌশলী আড়াল ছাড়াই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
১৯৪০-এর দশকে, যখন স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দাঙ্গার অন্ধকার ক্রমেই ঘনিয়ে আসছিল, বাংলায় এক ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়—একটি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যা ব্রিটিশদের পরিকল্পিত পদক্ষেপের ফলস্বরূপ ঘটে এবং এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন, যদিও মোট খাদ্যশস্যের প্রকৃত ঘাটতি ছিল না। এই দুর্ভিক্ষ মানুষকে খাদ্যের জন্য ভিক্ষা করতে, চুরি করতে এবং এমনকি হত্যা করতেও বাধ্য করে। সেই সময় থেকে খাদ্য, ক্ষুধা এবং সামাজিক অবিচার বাংলার বহু কথাসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে, যেখানে এই থিমটি ধীরে ধীরে প্রতীকী অর্থে রূপান্তরিত হয়ে গভীরতর সামাজিক বার্তা বহন করতে শুরু করে।
১৯৪০-এর দশক ছিল বাংলার জন্য এক সত্যিকারের অস্থির সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানি আক্রমণের ভয় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। জাপানি বিমান বাহিনী ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বোমা বর্ষণ করে। এই হামলাগুলি আতঙ্ক, গণ-উচ্ছেদ এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতির সৃষ্টি করে, যা জীবনযাত্রায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা বয়ে আনে। এই দুটি হামলার মধ্যবর্তী সময়েই আসে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। এই দুর্যোগগুলো কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পরপরই সারা বাংলাজুড়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সহিংস দাঙ্গা শুরু হয়, যার তীব্রতা কলকাতায় সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। এই দাঙ্গা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করে এবং ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমানায় দেশভাগের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত করে। বাংলার যে সব জেলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেগুলি নবগঠিত পাকিস্তানের—নির্দিষ্ট করে বললে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, কেননা স্বাধীন পাকিস্তান ছিল দুটি অংশে বিভক্ত—ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব অংশে।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের ফলে একটি বিশাল জনসংখ্যা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে স্থানান্তরিত হয়, যা ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ স্থানান্তর হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সীমানাটি ভারত ত্যাগের পূর্বে ব্রিটিশ ভারত সরকারের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। যেসব মুসলমানদের বাড়ি ভারতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে ছিল, তাদের অনেকে নিকটবর্তী পশ্চিম বা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তেমনি যেসব হিন্দুদের বাড়ি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় ছিল, তারা স্বাধীন ভারতে পুনর্বাসনের পথ বেছে নেন। বাংলায়, পাঞ্জাবের মতোই, এবং পাকিস্তানে এই স্থানান্তরের ফলে বিশাল শরণার্থী প্রবাহ সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গে—যা মূল বাংলার ভারতের অন্তর্ভুক্ত অংশ ছিল—প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলতেন। নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন দেশে স্থাপিত হওয়ার মানসিক আঘাত, যদিও সাংস্কৃতিক সংযোগ দৃঢ় ছিল, বাংলা কথাসাহিত্য, শিল্পকলা এবং সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। এই গল্পগুলো স্থানান্তরের প্রক্রিয়ার চেয়ে এর পরিণতি নিয়ে অধিক মনোযোগী, যা নতুন আন্তর্জাতিক সীমান্তের উভয় পাশে থাকা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
পূর্ব পাকিস্তান গঠনের পরপরই একটি নতুন অস্থিরতা শুরু হয়। এখানকার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ভাষা আন্দোলন—বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম—১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকায় সূচিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকায় কলেজ ছাত্রদের নেতৃত্বে সংগঠিত প্রতিবাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠোর দমন নীতির ফলে কয়েকজন তরুণ প্রাণ হারান। এই দিনটি বাংলাভাষী মানুষের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে এবং পরে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই আন্দোলন ১৯৬০-এর দশকে আরও বেগবান হয় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়—যার নাম এসেছে তাদের মাতৃভাষা বাংলা থেকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় সফল হয়; ততদিনে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের তীব্র শত্রু হয়ে উঠেছিল এবং ১৯৬৫ সালে তাদের মধ্যে একটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়।
পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন এবং ১৯৭০-এর দশকের সহিংস পরবর্তী রাজনীতি। এই সহিংসতার প্রবাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০–৭৫) ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার হাতে প্রাণ হারাতে হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি বাংলাদেশের সাহিত্যিক সৃষ্টিতে গভীর মানসিক ছাপ ফেলে এবং সাহিত্যে বারবার ফিরে আসে, যেখানে এই আঘাতের প্রতিফলন ক্রমাগত অনুভূত হয়।
একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কথাসাহিত্যিকরা নিজেদের জন্য নতুন সাহিত্যিক শৈলী গড়ে তুলছিলেন—প্রচলিত গল্প বলার ধারা থেকে সরে এসে ভাষার সম্ভাবনাগুলিকে আরও স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করছিলেন, যেমনটি তখন পাশ্চাত্যে ঘটছিল। একইসাথে, তারা নকশালবাদের নামে পরিচিত একটি সহিংস অতিবামপন্থী আন্দোলনের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। এর প্রভাবে বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কাজগুলির উদ্ভব ঘটে, যেখানে বেশ কয়েকজন লেখক সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে এই সহিংসতা এবং এর ব্যর্থ মতাদর্শ বিশ্লেষণ করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন এবং তাদের গল্পের মাধ্যমে এই সময়ের মানবিক বিপর্যয়কে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরেন, যা গভীর হতাশা এবং প্রচলিত ধারার বাইরে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বাংলা কথাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সম্পর্কের বিশ্লেষণ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল। ১৯৬০-এর শেষের দিকে কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাসে এই বিষয়টি উন্মোচিত হতে শুরু করে এবং ১৯৭০-এর দশকেও তা অব্যাহত থাকে, তবে মূলত ১৯৮০-এর দশকেই ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্কের জটিলতাগুলি কথাসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের উভয় পাশেই বাংলা সাহিত্যে এই ব্যক্তিগত সম্পর্কের অনুসন্ধান একটি ধারাবাহিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে।
যদি বিভিন্ন দশক থেকে বাছাই করা বাংলা ছোটগল্পের একটি সংকলনকে সেই সময়ের, মানুষের এবং স্থানের ইতিহাস বলার একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে তা ভুল হবে না। তবে, এই গল্পগুলি শুধু ইতিহাস নয়—এটি ভূমির এবং মানুষের, কিংবা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু। যেকোনো সাহিত্যের মতোই, এই গল্পগুলি লেখকদের এবং তাদের দেখা, অনুভব করা, এবং এমনকি তাদের প্রত্যাখ্যাত পৃথিবীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ও অনন্য সংলাপের প্রতিফলন। এই গল্পগুলির মধ্যে ‘বাংলা পরিচয়’ সরাসরি উন্মোচিত নয়। এগুলি এমন গল্প নয় যা নৃতত্ত্বের সংকলন হিসেবে রচিত, এবং এমন কোনো বুদ্ধিদীপ্ত নির্দেশনাও নয় যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এবং তাদের জগৎ সম্পর্কে জানতে চাওয়া পাঠকদের জন্য তৈরি হয়েছে।
অবশেষে, এই গল্পগুলি বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছিল পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং সেই জগতের মানুষের জন্য, যাদেরকে এগুলি চিত্রিত করে। এই গল্পগুলি কোনো অপরিচিত জগতে প্রবেশের দ্বার নয়; বরং পরিচিত জগতে নতুন করে উঁকি দেওয়ার একটি জানালা হিসেবে রচিত হয়েছিল। এগুলি বঙ্গের সামগ্রিক প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট লেখকদের সৃষ্টির প্রতিফলন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও, প্রিয় পাঠক, হয়তো এখানে আপনি এক সূক্ষ্ম সুতোর সন্ধান পাবেন যা এই গল্পগুলিকে একত্রে বেঁধে রেখেছে। হয়তো এটি এমন কিছু সহজ, যা অনুপস্থিত কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা; অথবা পৃথিবী যেমন আছে, তেমন থাকার প্রতি এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ; অথবা মানব অস্তিত্বের সেই রহস্য, যা সম্পূর্ণরূপে বোঝা প্রায় অসম্ভব, যা কেবলমাত্র মেনে নিয়েই নথিবদ্ধ করা যেতে পারে—সবই হতে পারে।
এখানে নেই কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, দৃঢ় যৌক্তিক কাঠামো কিংবা প্রতিনিধিত্বমূলক করার কোনো প্রচেষ্টা, এমনকি নেই কোনো সাহিত্যিক সঙ্গতিও। এই সংকলনকে আপনি বলতে পারেন এমন একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পছন্দের প্রতিফলন, যিনি এই গল্পগুলিকে এমনভাবে পড়ার উপযুক্ত মনে করেছেন, যেখানে মন, হৃদয়, পেশী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কল্পনা, উচ্ছ্বাস, বিষণ্নতা, ভালোবাসা—এক কথায়, একটি ছোটগল্প পড়ে তাতে গভীরভাবে মগ্ন হওয়ার জন্য মানবিক অনুভূতির প্রতিটি উপাদান উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। এই বইটি হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
প্রথম প্রকাশিত গল্পপাঠ-এ
Buy this book from The Penguin.