জ্ঞানগত সংকটের যুগে পাঠ কেন অপরিহার্য
মুদ্রিত বইগুলি নিমগ্ন পাঠের অভিজ্ঞতা প্রদান করে যা ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের আকর্ষণ সত্ত্বেও, মুদ্রিত বইয়ের অনন্য অন্তর্মুখিতা এবং নিমজ্জন আমাদের জীবন ও সাহিত্য বোঝার জন্য অপরিহার্য।
এড সিমন
এড সাইমন যুক্তি দিয়েছেন যে মুদ্রিত বইগুলি এমন নিমগ্ন পাঠের অভিজ্ঞতা প্রদান করে যা ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি সভেন বারকাটসের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ইলেকট্রনিক মাধ্যমের বিপদ এবং "নিমগ্ন পাঠের" পতন সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। সাইমনের বিশ্বাস, ইন্টারনেটের আকর্ষণ সত্ত্বেও, মুদ্রিত বইয়ের অনন্য অন্তর্মুখিতা এবং নিমজ্জন আমাদের জীবন ও সাহিত্য বোঝার জন্য অপরিহার্য।
১৯৯৫ সালে ইংরেজি ফ্যান্টাসি লেখক টেরি প্র্যাচেট যখন জিকিউ পত্রিকার জন্য বিল গেটসের সাক্ষাৎকার নেন তখন মাত্র ৩৯% আমেরিকানের বাড়িতে কম্পিউটার ছিল। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪%। ইন্টারনেট যুগের সূচনায়, যখন তথ্যের অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভরা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার ঝড় বইছিল, টেরি প্র্যাচেট সেই উৎসাহে খানিকটা সংযমী ছিলেন।
মাইক্রোসফটের সিইওর সঙ্গে কথা বলার সময়, প্র্যাচেট জিজ্ঞেস করেন, যদি কোনো লেখক ইন্টারনেটে বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর কিছু, যেমন হলোকাস্ট অস্বীকারের ভুয়া একাডেমিক লেখা প্রচার করে, তবে কী হবে? সাথে যুক্ত করেন “নেটে তথ্যের একটি সমতা রয়েছে—কোনো কিছুর ভিত্তি আছে কি নেই, তা যাচাই করার কোনো উপায় নেই।” প্রত্যাশামতোই গেটস এ ধরনের জ্ঞানগত সংকটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেন। কোনো কার্যকর পদ্ধতির ব্যাখ্যা না দিয়েই তিনি বলেন, “ইন্টারনেটে কর্তৃপক্ষ থাকবে... কারও সুনামের যাচাই প্রক্রিয়া অনেক উন্নত হবে।” তখন গুগল আসতে আরও তিন বছর বাকি, ফেসবুক প্রতিষ্ঠিত হবে নয় বছর পর, আর টুইটার এগারো বছর পর। ১৯৯৫ সালে প্র্যাচেটের বিদ্রূপাত্মক ও সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গি যেমন সময়োপযোগী ছিল, তেমনি তিন দশক পর গেটসের অতিরিক্ত আশাবাদ ও নিষ্পাপ উচ্ছ্বাস আজ পাগলামির মতো মনে হয়।
প্র্যাচেটের সতর্কবার্তা হয়তো প্রযুক্তির প্রতি উচ্ছ্বাসে ভরা সেই দূর অতীতে বেশ কোণঠাসা ছিল, কিন্তু তিনি একমাত্র ভবিষ্যদ্রষ্টা নন, যিনি স্মার্টফোনের পর্দার ওপারে বাস্তবতার অন্ধকার সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত দ্য ডেমন-হন্টেড ওয়ার্ল্ড: সায়েন্স অ্যাজ আ ক্যান্ডল ইন দ্য ডার্ক-এ জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “যখন ভয়াবহ প্রযুক্তিগত ক্ষমতা কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে... এবং মানুষ তাদের নিজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ বা কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার জ্ঞান হারাবে,” তখন জাতি প্রায় অজান্তেই আবার কুসংস্কার ও অন্ধকারের দিকে পিছিয়ে যাবে।
পূর্ববর্তী শতাব্দীর শেষ দশকে, সোভিয়েত কমিউনিজমের পতন এবং আমেরিকান আদর্শের ক্রমাগত উত্থানের সময়, অনেক পাঠকের কাছে মনে হয়েছিল যে নৈতিক জগতের বাঁক প্রযুক্তির মুক্তিদায়ক শক্তির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে প্র্যাচেট ও সাগান যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা ছিল এক আসন্ন অস্থিরতার সময়—ইতিহাসের সমাপ্তি নয়, বরং সত্যের বিলুপ্তি। এটি কম্পিউটারের বিপ্লবের চেয়ে বেশি, কম্পিউটারের এক প্রলয়।
প্র্যাচেট বা সাগানের আগেই—সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্টফোন, বট ফার্ম কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ শুরুর অনেক আগে—এসেছিল সভেন বারকাটসের কঠোর সমালোচনামূলক রচনা, দ্য গুটেনবার্গ এলিজি: দ্য ফেট অফ রিডিং ইন অ্যান ইলেকট্রনিক এজ। তিরিশ বছর আগে, ১লা ডিসেম্বর প্রকাশিত এই বইয়ে বারকাটস সেই ডিজিটাল রূপান্তরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, একটি ঘোষণাপত্র হিসেবে, দ্য গুটেনবার্গ এলিজি ’৯০-এর দশকের প্রযুক্তি-উত্সাহী ইউটোপিয়াবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, মুদ্রিত বইয়ের অবমূল্যায়নে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।
লেখকের মতে, মুদ্রিত বইকে ইন্টারনেটের ক্ষণস্থায়ী পর্দার কাছে সমর্পণ করা আমাদের মনোযোগ এবং জটিল বর্ণনার গভীরে ডুবে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য হুমকি স্বরূপ। বারকাটস লিখেছেন, “আধুনিক সমাজের প্রতিটি উপাদান অভ্যন্তরীণতা নিরুৎসাহিত করে। আমাদের অধিকাংশ যোগাযোগই এখন সার্কিটের মাধ্যমে হয়, এবং সেসব বিনিময়ের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যই আমাদেরকে ভার্চুয়াল বর্তমানের ঘোরে আটকে রাখে, যা আমাদের নিজস্ব সত্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।” ১৯৯৪ সালে এই পর্যবেক্ষণ আজ কতটাই না প্রাসঙ্গিক!
সত্তার এই ভার্চুয়াল বিলোপের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে বারকাটস সাহিত্যের কাছে ফিরে যান। তিনি যুক্তি দেন, বইয়ের “ধীর এবং মননশীল অধিকার”—যা তিনি “গভীর পাঠ” বলে অভিহিত করেন—আমাদের সেই বিপজ্জনক ও রোমাঞ্চকর ধারণাটি জীবিত রাখতে সাহায্য করে যে জীবন শুধু ক্রমান্বয়ে বসবাস করা মুহূর্ত নয়, বরং একটি পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য।
অনেক সমালোচক বারকাটসকে "বিকল্পহীন রক্ষণশীল" বলে তিরস্কার করেছেন। কিরকাস (সাহিত্য পত্রিকা)-এর বেনামী এক পর্যালোচক তাকে “অভ্যস্ত বইপোকা” এবং “খিটখিটে বৃদ্ধ” হিসেবে আখ্যা দিয়ে তার কাজকে “সরলীকৃত ও অপ্রত্যয়ী শোকগাথা” বলে অভিহিত করেন। শিকাগো রিভিউ-এর ওয়েন স্টিফেনসন দাবি করেন, মাধ্যম নয়, বার্তাই আসল বিষয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, পৃষ্ঠায় বা পর্দায় সিমাস হিনির কবিতা পড়ায় কোনো পার্থক্য অনুভব করেননি, এমনকি প্রশ্ন তুলেন, “এটা কি গুরুত্বপূর্ণ যে এটি কম্পিউটার দিয়ে শব্দ ও কণ্ঠে এসেছে? প্রশ্নটা এখন আমাকে বিরক্ত করছে।”
ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস-এর ডিন ব্লোবাউম সমালোচনা করেন, দ্য গুটেনবার্গ এলিজি পশ্চিমা সমাজের সকল সমস্যার জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে "বলির পাঁঠা" বানিয়েছে। তার মতে, বারকাটস শিক্ষা, এবং সাহিত্য সংস্কৃতির পতনের জন্য অত্যধিকভাবে কম্পিউটারকেই দোষারোপ করেছেন। তবে ত্রিশ বছর পর একটি বিষয় স্পষ্ট—বারকাটস সঠিক ছিলেন।
এই নেতিবাচক পর্যালোচনাগুলোর কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি ভুল বোঝাবুঝি—ইন্টারনেটে প্রক্রিয়াকৃত তথ্য এবং দুই সহস্রাব্দ পুরোনো প্রযুক্তি মুদ্রিত গ্রন্থের মধ্যে পার্থক্য কতটা গভীর। কিরকাস-এর পর্যালোচক উদাহরণস্বরূপ একটি কল্পিত বারকাটসকে উপস্থাপন করেছেন, যিনি ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে "বলপেন, টাইপরাইটার, মুদ্রণযন্ত্র" নিয়ে বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু এই সমালোচনার মূল ফাঁকটি হলো, এসব ছিল উৎপাদনের প্রযুক্তি, আর ইন্টারনেট কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি গ্রহণের মাধ্যমও।
ডিজিটাল পাঠের উন্মত্ত, আন্তঃসংযুক্ত, হাইপারটেক্সট-জর্জরিত জগত একেবারেই ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, শেলফে রাখা একটি মুদ্রিত বই নিজেই একটি পৃথক মহাবিশ্ব; যেখানে অন্তর্মুখিতা, নিজস্বতা এবং গভীর চিন্তার জগৎ বিদ্যমান। ভার্চুয়াল জগতে এই গোপনীয়তা এবং আত্মবিশ্লেষণের মাত্রা অনেকটাই ঝাপসা হয়ে যায়।
"যদি আমার পড়ার অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে, তবে তা হলো—একটি বই যে অবস্থায় আমাকে নিয়ে যায়, সেই অভিজ্ঞতাকে এখন আমি তার বিষয়বস্তুর চেয়েও বেশি মূল্য দিই," বলেছিলেন বারকাটস। ত্রিশ বছর আগে হয়তো এটি অতিমূল্যায়ন মনে হয়েছিল, কিন্তু আজ এটি অমূল্য বলে মনে হয়।
কারণ, পড়া এখনো আমাদের জীবনের কেন্দ্রীয় উপাদান, বরং ইতিহাসে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ডিজিটাল জীবন শব্দের মাধ্যমেই গঠিত—হোক তা টুইটারের উন্মাদনা, রেডিটের নিরন্তর স্ক্রলিং, নোটিফিকেশনের পিং ধ্বনি, কিংবা ফেসবুকের প্রবাহমান হাতছানি। তবে এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা, যেমনটা উইদারিং হাইটস, মবি-ডিক, মিসেস ডালাওয়ে বা ইউলিসিস পড়ার গভীরতায় নিমজ্জিত হওয়া। শুধু বই পড়ার অভ্যাসই নয়, পড়ার আনন্দও আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
পড়ার গভীর স্রোত একজন পাঠককে অন্য এক অস্তিত্বে নিমজ্জিত করে, সম্ভাবনা ও চেতনার প্রসার ঘটায়। গ্যেটে বা শিলার পড়া বহু নাৎসির উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মহান সাহিত্য মানুষকে মহান করে তোলে—ধারনাটি অবান্তর। তবে গভীর পাঠ পরিত্যাগ করা মানে এমন কিছু হারানো যা স্বতন্ত্র, মূল্যবান এবং অন্তর্নিহিত।
বারকাটস লিখেছেন, “উপন্যাস পড়ি আমি একটি কেন্দ্রীভূত এবং সুনির্দেশিত অন্তর্লৌকিক ক্রিয়ায় নিমগ্ন হতে, যা আমার নিজের অন্তর্জীবনকে সমান্তরালে চালনা করে, শাণিত করে এবং উদ্দীপ্ত করে।” আমিও আজকের ডিজিটাল শূন্যতার প্রতি অন্য সবার মতোই আকৃষ্ট, তবে আমার মনোযোগকে পাঠে নিবদ্ধ করতে হয়, নিজেকে এই অদ্ভুত জগত—উপন্যাসের মধ্যে বসবাসের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। এই সচেতনভাবে সময় উৎসর্গ করার অভ্যাস আমার জীবনে অপরিমেয় পরিবর্তন এনেছে।
এই নিবেদন ছাড়া—যা মূলত ইচ্ছার সচেতন চর্চা—আমি হয়তো সম্প্রতি ড্যানিয়েল মেসনের নর্থ উডস-এর শতাব্দীপ্রাচীন ভূতুড়ে বাড়ির মধ্য দিয়ে হেঁটে আসতে পারতাম না, র্যাচেল কুশনারের ক্রিয়েশন লেক-এ গুপ্তচর স্যাডি স্মিথের অবিশ্বাস্য চেতনার ঘোরে হারিয়ে যেতাম না, কিংবা আলেকসান্ডার হেমনের দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অল দ্যাট ইট হোল্ডস-এ পিন্টোর সঙ্গে গ্রেট ওয়ারের পর ইউরেশিয়ার বিশাল বিস্তৃতিতে ভ্রমণ করতাম না। এন্ড্রু ও’হেগানের ক্যালেডোনিয়ান রোড-এর শতাধিক জীবন্ত চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হতাম না—চাপে থাকা জেন-এক্স আর্ট হিস্ট্রি অধ্যাপক থেকে শুরু করে মানব পাচারের শিকার পোলিশ অভিবাসী, ব্রিটিশ লর্ড থেকে পূর্ব লন্ডনের হিপ-হপ শিল্পী—একটি সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব যা শক্ত মলাটের দুই পাতার মধ্যে বাঁধা এবং ৬২৪ পৃষ্ঠায় চিরন্তন হয়ে আছে।
বই এমন শক্তি রাখে যা বারকাটসের প্রিয় অন্তর্লৌকিকতাকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি সময়-স্থান সারণি বেঁকিয়ে দিতে পারে। কাতিয়া আপেকিনা তার মাদার ডল উপন্যাসে লিখেছেন, যা এই বছর আমার ভ্রমণ করা আরেকটি মহাবিশ্ব, “সময় বলে কিছু নেই... কিন্তু এটি অবিরাম।”
একটি মুদ্রিত বই হলো এক জীবন্ত প্রাণী—কাগজের দেহ আর রক্তের কালি দিয়ে তৈরি। পৃষ্ঠা ওল্টানোর অভিজ্ঞতার তুলনায় কেবল স্ক্রল করা যেন প্রাণহীন। বারকাটস প্রিন্টের মরমি ভাববাদী নন, তবে আমি তা নিশ্চিতভাবেই। যদিও আমার মরমিবাদ একটি স্পষ্ট বস্তুবাদী ধারা—কেননা বইয়ের যন্ত্রের ভেতরে অর্থ হলো আত্মা। গুটেনবার্গ (জার্মান স্বর্ণ-খনিজীবী) মুভেবল প্রিন্ট তৈরির ধারণা পান আঙ্গুর চেপে ওয়াইন তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র দেখে, যা আঙ্গুরের রস নিষ্কাশনে ব্যবহৃত হতো।
ইন্টারনেটের ক্ষণস্থায়িত্ব বিশৃঙ্খলার প্রতি আকর্ষিত, কারণ গত কয়েক দশকে যা লেখা হয়েছে তার অনেকটাই প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, আমাদের দৈনন্দিন বিপুল সৃষ্টিকর্ম যেন আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের প্রতিদিনের দহন। অন্যদিকে, পাথর, প্যাপিরাস, ভেলাম এবং কাগজ শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকে। একটি মুদ্রিত বই এমন এক জীবন্ত প্রাণী, যার কাগজের দেহ আর রক্তের কালি, তাই পৃষ্ঠা ওল্টানোর তুলনায় স্ক্রল করাটা একেবারেই নির্জীব।
ইন্টারনেট একটি জগত। সিলিকন, তামা, সার্কিট বোর্ড আর সোল্ডারিং দিয়ে তৈরি হলেও, একে প্রায়শই এক ধরনের বিমূর্ত, দেহহীন, আধ্যাত্মিক জগত হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই ভ্রান্ত ধারণা প্রায় তিন দশক ধরে বিদ্যমান এবং সিলিকন ভ্যালির চরমপন্থী ডিজিটাল অলৌকিকবাদীরা এটিকে অদ্ভুত উৎসাহে গ্রহণ করেছে।
তবে বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ নিছক আবেগ নয়; বরং এটি এর কাজের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বলেই আমার ভালো লাগে। বইয়ের যে কাঠামো কোডেক্সের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তা এখনো একটি অপরিহার্য প্রযুক্তি।
ইরিন ভ্যালেজো তার প্যাপিরাস: দ্য ইনভেনশন অফ বুকস ইন দ্য এনশিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে রসিকতা করে বলেছেন, কোডেক্স এমন একটি বিরল আবিষ্কার যা টাইমট্রাভেল করা কোনো প্রাচীন রোমান সহজেই চিনতে পারবে। বইয়ের জায়গা কোদাল বা কুঠারের পাশে রাখা যায়, কারণ এদের চেহারা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রায় একই রকম। তবে বইকে নিখুঁত এবং অপরিবর্তনীয় করে তুলেছে এর চেহারা নয় (যা কখনো সুন্দর, কখনো কুৎসিত), এর মূল্য নয় (যা কখনো ব্যয়বহুল, কখনো সস্তা), বা এর টেকসইত্ব নয় (কিছু চিরকাল টিকে থাকে, কিছু নয়), বরং বইয়ের সত্যিকারের শক্তি তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতায়। এটাই সেই অন্তর্মুখিতার উৎস, যা বারকাটস উল্লেখ করেছেন—বই ইন্টারনেটের কোলাহলে আবদ্ধ নয়, বরং তা থেকে মুক্ত।
সমকালীন সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর একটি হলো জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি-ফোর উপন্যাসে উইনস্টন স্মিথের কাগজের ডায়েরি আগলে রাখা, যা সিসি ক্যামেরার সর্বদর্শী দৃষ্টির বাইরে। তিনি সেখানে গোপনে নিজের মতামত লিখে রাখেন। তবে সেই সিসি ক্যামেরা আজকের নজরদারি পুঁজিবাদের তুলনায় অত্যন্ত আদিম—আজ বিগ ব্রাদার নয়, বরং অ্যালেক্সা গোপনে শোনে।
মুদ্রিত বই এই অ্যালগরিদমিক দেবতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষেত্র। কোডের কারসাজি বইয়ের বিষয়বস্তু মুছে দিতে পারে না, যেমনটি সম্প্রতি হ্যাকাররা ইন্টারনেট আর্কাইভে করেছিল। বইয়ে এক ধরনের নিরাপত্তা রয়েছে, যেখানে বাইরে বসেই সাহিত্যের ব্যক্তিগত জগতে প্রবেশ করা যায়। আমার ভয় এই স্বাধীনতা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে ।
বিশ শতকের টোটালিটারিয়ানিজম নিয়ে কথা বলার সময় আমরা প্রায়শই ভুল করি, যেন অতীতের ভয়াবহ ঘটনাগুলো সেখানেই সুরক্ষিত রয়ে গেছে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে ভুল করে স্বাধীনতার সমার্থক মনে করি। ভাবুন তো দুর্বল আইবিএম পাঞ্চ কার্ড দিয়ে নাৎসিরা কতটুকু করতে পেরেছিল? আর আজকের বাস্তবতা—আমাদের প্রত্যেকের অসীম তথ্য সঞ্চিত আছে সেই সার্ভারগুলোতে, যা এখন স্বৈরশাসনকে সক্রিয় করার হাতিয়ার।
বারকাটস লিখেছিলেন, “সাহিত্যকে বেঁচে থাকতে হলে বিপজ্জনক হতে হবে”—এবং তা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, যদি আমাদের এই সময়ে টিকে থাকতে হয়, তাহলে আমাদের আবারও প্রকৃত অর্থে সাহিত্যে ফিরে যেতে হবে।
প্রবন্ধটি এড সিমন লিখেছেন, লিটহাবে প্রকাশিত হয় ২২ নভেম্বর ২০২৪।
অনুবাদ: রিটন খান