আমেরিকার প্রারম্ভিক যুগে কুরআন
থমাস জেফারসন ১৭৬৫ সালে কুরআনের একটি অনুলিপি ক্রয় করেন। ভার্জিনিয়ার ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন রচনা করে তিনি এ দেশের ভবিষ্যৎকে এমনভাবে কল্পনা করেছিলেন যেখানে সকল ধর্ম সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে।
![tj_koran_vols_583.jpgথমাস জেফারসনের দুই খণ্ডের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা জর্জ সেলের ১৭৩৪ সালে অনূদিত কোরআনের অনুবাদ এখন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সংগ্রহে সংরক্ষিত। tj_koran_vols_583.jpgথমাস জেফারসনের দুই খণ্ডের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা জর্জ সেলের ১৭৩৪ সালে অনূদিত কোরআনের অনুবাদ এখন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সংগ্রহে সংরক্ষিত।](https://substackcdn.com/image/fetch/w_1456,c_limit,f_auto,q_auto:good,fl_progressive:steep/https%3A%2F%2Fsubstack-post-media.s3.amazonaws.com%2Fpublic%2Fimages%2F03f740ee-26fd-45ea-b48e-2d0da35c52d1_1000x750.webp)
ওয়াশিংটনের কংগ্রেস লাইব্রেরি শুধুমাত্র আমেরিকার ঐতিহাসিক দলিল নয়; এটি এক অর্থে এই জাতির স্ববিরোধী চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। এ লাইব্রেরির বিপুল সংগ্রহে রয়েছে দুটি বিশেষ বই—যেগুলি আমেরিকার ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং দাসত্বের নির্মম বাস্তবতা প্রকাশ করে। একটি হলো থমাস জেফারসনের সংগ্রহে থাকা কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ, আর অন্যটি ওমর ইবনে সাঈদের আত্মজীবনী, যিনি আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে আনা এক মুসলিম পণ্ডিত। এই বই দুটি আমেরিকার অন্তর্ভুক্তি ও বঞ্চনার ইতিহাসে এক অনন্য দ্বৈত চিত্র তুলে ধরে।
থমাস জেফারসন ১৭৬৫ সালে কুরআনের একটি অনুলিপি ক্রয় করেন। এটি এমন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। সেই যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। জেফারসনও এই ধারা থেকে বিচ্যুত ছিলেন না। ভার্জিনিয়ার ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন রচনা করে তিনি এ দেশের ভবিষ্যৎকে এমনভাবে কল্পনা করেছিলেন যেখানে “ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম (মোহাম্মদান), হিন্দু, এমনকি নাস্তিক ব্যক্তিও” সমান অধিকার ভোগ করতে পারবেন।
তাঁর এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি শুধু তাত্ত্বিক ছিল না। ১৮০৫ সালে যখন মুসলিম রাষ্ট্রদূত সিদি সোলাইমান মেলিমেলি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, তখন রমজান উপলক্ষে ইফতারের সময়ে রাষ্ট্রীয় ভোজসভার সময়সূচি পরিবর্তন করে জেফারসন দেখিয়েছিলেন তাঁর ধর্মীয় সংবেদনশীলতা।
কিন্তু এই উদারতা ছিল সীমাবদ্ধ। মোন্টিসেলো প্রাসাদ—যেটি জেফারসনের বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতার প্রতীক—তা মূলত গড়ে উঠেছিল দাসশ্রমের মাধ্যমে। এই প্রাসাদ তাঁর দ্বিচারিতার বাস্তব চিত্র বহন করে।
থমাস জেফারসনের মতো তাত্ত্বিক নয়, ওমর ইবনে সাঈদ তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন জীবনের নির্মম বাস্তবতার মধ্যে। ১৭৭০ সালে ফুটা তোরোর একটি ইসলামিক শিক্ষার কেন্দ্র থেকে তিনি দাস হিসেবে বন্দি হন। আমেরিকায় এনে তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তাঁর জীবন হয়ে ওঠে দাসপ্রথার নিষ্ঠুরতার উদাহরণ।
তাঁর আত্মজীবনী আরবিতে লেখা, যা শুরু হয় কুরআনের সূরা আল-মুলকের আয়াত দিয়ে। এই সূরাটি ন্যায়বিচার ও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কথা বলে। এটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিবাদ, এক অর্থে তাঁর ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা।
ওমরের কাহিনি একক কোনো ঘটনা নয়। গবেষণায় দেখা যায়, হাজার হাজার আফ্রিকান মুসলিমদের দাস হিসেবে আমেরিকায় আনা হয়েছিল। তাদের অনেকেই কুরআনের আয়াত মুখস্থ করে রেখেছিলেন, আরবিতে লিখেছেন, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
জেফারসনের কুরআন এবং ওমর ইবনে সাঈদের আত্মজীবনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমেরিকার প্রারম্ভিক ইতিহাসের জটিলতা। একদিকে উদার ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণা, অন্যদিকে দাসত্বের নির্মম বাস্তবতা—এই দ্বৈত চিত্র এই জাতির ভিত্তি।
২০০৭ সালে কংগ্রেস সদস্য কিথ এলিসন যখন জেফারসনের কুরআনে শপথ গ্রহণ করেন, তখন তা ছিল এক প্রতীকী বার্তা। এটি দৃষ্টি ফেলে যে ইসলাম শুধু আমেরিকার বর্তমান নয়, এর ইতিহাসেরও অংশ।
ওমর ইবনে সাঈদের মতো দাস মুসলমানদের উপস্থিতি আমাদের ইতিহাসের সেই অংশের দিকে চোখ ফেরায় যা এতদিন অনুচ্চারিত ছিল। তাঁদের সংগ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সমতা অর্জনের পথ আজও অসমাপ্ত।
থমাস জেফারসনের কুরআন এবং সাঈদের আত্মজীবনী কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়। তারা আমেরিকান জাতির জটিল সত্যগুলো বোঝার জানালা। আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—কিভাবে অতীতের প্রতিশ্রুতিকে বর্তমানের বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো যায়? কিভাবে আমরা সেই সব কণ্ঠস্বরকে স্মরণ করতে পারি, যারা এই জাতির আখ্যানকে গঠন করেছে এবং করছে?
আমাদের উত্তর খুঁজতে হবে তাদের জীবনে, যাঁরা অব্যাহত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।